রুগ্‌ন হয়ে পড়ছে মালয়েশিয়ার অর্থনীতি

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥২০১৬ সালে আকস্মিকভাবেই অবসর থেকে ফিরে মালয়েশিয়ার রাজনীতির সব হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছিলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মাহাথির মোহাম্মদ। পরের বছর নির্বাচনে নিজের সাবেক রাজনৈতিক শিষ্য নাজিব রাজাককে পরাজিত করে দেশটির শাসনভার হাতে তুলে নেন তিনি। আলোচিত ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারিসহ ব্যাপক দুর্নীতি ও মালয়েশীয় অর্থনীতির দুর্বল ব্যবস্থাপনার অভিযোগে নাজিব রাজাক প্রশাসনের তখন বেহাল দশা। ফলে ব্যক্তিগত কারিশমা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জয় পেতে মাহাথির মোহাম্মদেরও তেমন কোনো বেগ পেতে হয়নি। ওই ঘটনায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক খাতসংশ্লিষ্ট ও রাজনীতিবিদরা। মাহাথিরের প্রত্যাবর্তন দেশটিকে ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রুগ্ণ মানব’ হয়ে ওঠা থেকে রক্ষা করেছে বলে নানাভাবে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করতে থাকেন তারা।
মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর ক্ষমতায় আসেন মুহিউদ্দিন ইয়াসিন। ঠিক ওই সময়টিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রকট হয়ে ওঠে মহামারী কভিড-১৯-এর ছোবল। মহামারীকালে দেশটির অর্থনীতি সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের পেরিকাতান নাসিওনাল (পিএন) জোট সরকার। গত বছর সংকুচিত হয়েছে দেশটির অর্থনীতি। কমেছে বিদেশী বিনিয়োগও। এর বিপরীতে বেড়েছে কর্মহীনতা। চলতি বছর দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা করছিলেন খাতসংশ্লিষ্টরা। কিন্তু তাদের সে আশার গুড়ে বালি হয়ে এসেছে করোনার তৃতীয় প্রবাহ। মহামারী মোকাবেলায় আবারো লকডাউনে যেতে বাধ্য হয়েছে দেশটি। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আবারো ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রুগ্ণ’ মানব হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে মালয়েশিয়ার সামনে।
ক্ষয়িষ্ণু ব্যবসায়িক পরিবেশ ও অর্থনৈতিক দুর্বিপাকের মধ্য দিয়ে যাওয়া দেশকে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের রুগ্ণ মানব হিসেবে আখ্যা দেয়ার প্রচলন হয় ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি। ১৮৫৩ সালে প্রথম অটোমান তুরস্ককে ‘ইউরোপের রুগ্ণ মানব’ হিসেবে উল্লেখ করতে থাকেন পশ্চিমা অর্থনীতিবিদরা। পূর্ব বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে বাগধারাটির ব্যবহার হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত শতকের সত্তর ও আশির দশকে ফিলিপাইনকে বলা হতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রুগ্ণ মানব। ফার্দিনান্দ মার্কোসের স্বৈরশাসনে দেশটির অর্থনীতি সে সময় খুব বাজে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছে। মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও। ফার্দিনান্দ মার্কোসের পতন হয় ১৯৮৬ সালে। এরপর ফিলিপাইনে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে লেগে গিয়েছে আরো কয়েক দশক।
মালয়েশীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন ও নিবন্ধের ভাষ্যমতে, দেশটির সরকার যথোপযুক্ত উপায়ে মহামারী নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে দেশটির ওপর দিয়ে এখন বয়ে যাচ্ছে করোনার তৃতীয় প্রবাহ। এ কারণে চলতি বছরের শুরুতেই দ্বিতীয়বারের মতো জনসাধারণের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপে বাধ্য হয় মুহিউদ্দিন ইয়াসিন সরকার। অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও এখন দেশটিতে বিনিয়োগের তেমন একটা আস্থা পাচ্ছেন না।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক কনফারেন্সের (আঙ্কটাড) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে করোনার কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিদেশী বিনিয়োগের প্রবাহ (এফডিআই) কমেছে ৩১ শতাংশ। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক অন্যান্য দেশের তুলনায় মালয়েশিয়ার দিকেই তুলনামূলক কম আগ্রহ দেখিয়েছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। এ সময় মালয়েশিয়ায় সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের তুলনায় এফডিআই প্রবাহ কমেছে গড়ে ৬৮ শতাংশ। এর বিপরীতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এককালের রুগ্ণ মানব ফিলিপাইনে এ সময় এফডিআই বেড়েছে ২৯ শতাংশ।
অথচ একসময় মালয়েশিয়া হয়ে উঠেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী। অর্থনীতির অব্যাহত অগ্রগতির কারণে কিছুদিন আগেও দেশটিতে প্রচুর বিদেশী কর্মীর প্রয়োজন পড়েছে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসী কর্মীদের কাছে একসময় সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছিল মালয়েশিয়া। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশটি এখন স্থানীয়দেরই কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। দেশটির সরকারের সর্বশেষ প্রকাশিত পরিসংখ্যানও বলছে, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশটিতে চাকরি হারিয়েছে ৭ লাখ ৬৪ হাজারেরও বেশি মানুষ। নভেম্বর পর্যন্ত ২০২০ সালে দেশটিতে কর্মহীনতা বেড়েছে সাড়ে ৪ শতাংশ। দেশটির অন্যতম শীর্ষ থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান সোশিও ইকোনমিক রিসার্চ সেন্টারের (এসইআরসি) এক প্রক্ষেপণেও চলতি বছর দেশটিতে কর্মহীনতা বৃদ্ধির এ প্রবণতা বজায় থাকবে বলে জানা গিয়েছে। সেক্ষেত্রে চলতি বছর দেশটিতে কর্মসংস্থান হ্রাসের হার দাঁড়াবে সাড়ে ৪ শতাংশে। অন্যদিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান এমআইডিএফ রিসার্চের সংশোধিত প্রাক্কলন অনুযায়ী, গত বছর দেশটিতে কর্মহীনতা বেড়েছে সাড়ে ৪ শতাংশ। চলতি বছর কর্মসংস্থান হ্রাসের এ হার দাঁড়াতে পারে ৩ দশমিক ৮ শতাংশে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশটিতে কর্মসংস্থান ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসার প্রত্যাশা এ মুহূর্তে কেউই করছে না। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশটিতে কর্মরত প্রবাসী কর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয়দের মধ্যেও এখন কর্মসংস্থান নিয়ে বড় ধরনের দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
মাহাথির মোহাম্মদ ক্ষমতা ছেড়েছিলেন মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে। দেশটির রাজনৈতিক পরিবেশে এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। অন্যদিকে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসারও তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) থেকে দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু এ সময় করোনার সংক্রমণ আকস্মিকভাবে দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকায় আবারো জনসাধারণের চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ফলে চলতি প্রান্তিকে দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সম্ভাবনাই দেখতে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।
এ পরিস্থিতির জন্য দেশটির সরকারের করোনা মোকাবেলায় ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন দেশটির পার্লামেন্টের এমপি ওং কিয়ান মিং। সম্প্রতি দেশটির স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি বলেন, পেরিকাতান নাসিওনাল সরকারের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বই এখন মালয়েশিয়াকে ‘এশিয়ার রুগ্ণ মানব’ হিসেবে অভিহিত করার পথ করে দিয়েছে।