চৌগাছায় কর্মসৃজন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ

0

এম. এ রহিম চৌগাছা (যশোর) ॥ যশোরের চৌগাছায় ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অনেক ইউনিয়নে এ প্রকল্পের কাজ না করানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরেজমিনে চৌগাছা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। অনেকে কাজই শুরু করেননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ নভেম্বর থেকে চৌগাছা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন প্রকল্পের অধীনে ওয়েজ কস্ট’র আওতায় শ্রমিকদের দিয়ে সড়ক মেরামত কাজ শুরু হয়েছে। সপ্তাহে শনি থেকে বুধবার পাঁচ দিন করে মোট ৪০ দিনে উপজেলার ৬৮টি সড়ক মেরামত করা হবে। এতে মোট ২ হাজার ৩’শ ৯০ জন শ্রমিক ও ৬৮ জন শ্রমিক সর্দার কাজ করবেন। এতে সরকারের ব্যয় হবে ১ কোটি ৯২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে (১৩ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ১৭ দিনের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। চৌগাছার পাশাপোল, নারায়ণপুর, স্বরূপদাহ, ধুলিয়ানী, সুখপুকুরিয়া ও চৌগাছা সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় খাতাকলমে সংখ্যায় ঠিক থাকলেও প্রকল্পে কম সংখ্যক শ্রমিক কাজ করছেন। এদের মধ্যে আবার শিশু ও স্কুল ছাত্রও রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাশাপোল ইউনিয়নের বাড়ীয়ালী ওয়ার্ডে ২৩ জনের স্থলে কাজ করছেন ৭ জন। শ্রমিক সর্দার জানান, শুরু থেকেই ৭ জনই কাজ করেন। ওয়ার্ড মেম্বার মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল এখান থেকে ৮ জন শ্রমিক দিয়ে নিজের ধান উঠাচ্ছেন। এ ব্যাপারে মেম্বার মুকুল বলেন, ‘১৭/১৮ জন কাজ করছেন।’ আট জন আপনার ধান তুলতে নিয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনাদের সাথে পরে আমি দেখা করে নেব।’ এসময় সেখানে পৌছান পাশাপোল ইউপি চেয়ারম্যান অবাইদুল ইসলাম সবুজ। তিনি বলেন, ‘এটা লজ্জাজনক, অন্যায়। আমি সব মেম্বারকে কাজ ভাগ করে দিয়েছি। নিয়মিত মনিটরিংও করছি। কিন্তু কয়েকজন মেম্বার কোন কথা শুনছেন না। বিষয়টি আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানাবো।’ ইউনিয়নের পলুয়া ওয়ার্ডে ২৬ জনের স্থলে ২১ জন, পাশাপোল ওয়ার্ডে ৩৫ জনের জায়গায় ৩২ জন কাজ করছেন। লেবার সর্দার জানান, অন্য তিন জন অসুস্থ। বুড়িন্দিয়া ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার আশরাফুল ইসলাম বলেন, ৩৫ জনের স্থলে ২০ জন নিয়মিত কাজ করছেন। রানীয়ালী ওয়ার্ডের মেম্বার গোবিন্দ চন্দ্র বলেন, ২২ জনের স্থলে ১০ জন নিয়মিত কাজ করছেন। কালিয়াকুন্ডি ওয়ার্ডের মেম্বার মিলন চন্দ্র জানান, ১৭ জন কাজ করছেন। রঘুনাথপুর ওয়ার্ডে ২২ জনের স্থলে ৬ জন কাজ করছেন। শ্রমিক সর্দার আমানুল্লাহ জানান, শুরু থেকেই এই ৬ জন কাজ করছেন। দশপাকিয়া ওয়ার্ডে একদিনও কর্মসৃজনের কোন শ্রমিক দিয়ে কাজ করা হয়নি। মেম্বার আব্দুস সালাম বলেন, এখনও তিনি কাজ শুরু করেননি। তাহলে বিলের কী করবেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অফিস যেভাবে করবে, সেভাবে হবে।’ হাউলী ওয়ার্ডে কোন শ্রমিকই কাজ করছেন না। মেম্বার আব্দুর রহিমের বাড়িতে গেলে তিনি বলেন, ২৩ জনে ৬ জন কাজ করছেন। নারায়ণপুর ইউনিয়নে পেটভরা ওয়ার্ডে ২১ জনের স্থলে কাজ করছেন ১২ জন শ্রমিক। এর মধ্যে ৫ জন রয়েছেন স্কুল ও কলেজের ছাত্র। এ কাজের সর্দার জানান, অন্যদিন ১৩/১৪ জন শ্রমিক আসেন। আজ দু’জন কম এসেছেন। ওই ওয়ার্ডের মেম্বার ও ইউনিয়নের বর্তমানে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা মোস্তাক আহমেদ মোবাইল ফোনে জানান, সেখানে ১৪ জন শ্রমিক কাজ করছেন। তাহলে অন্য ৭ জন কোথায়? জানতে চাইলে তিনি বলেন, হয়তো আসেননি। নারায়নপুর ওয়ার্ডের লেবার সর্দার মনিরুজ্জামান বলেন, ৪৪ জনের জায়গায় এখানে ২৬ জন শ্রমিক কাজ করছেন। এদের মধ্যে দু’জন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ও একজন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। ইউপি মেম্বার ইউসুফ আলী বলেন, ‘৪৩ জনের স্থলে ২৯ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছেন। বাকিদের ব্যাপারে উপরের স্যাররা জানেন।’ বাদেখানপুর ওয়ার্ডে ২৯ জনের স্থলে কাজ করছেন ২২ জন। লেবার সর্দার আক্তার যশোরের একটি কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী। এখানেও তিনজন রয়েছে স্কুল শিক্ষার্থী। গুয়াতলী ওয়ার্ডের মেম্বার কামরুল ইসলামের ভাই লিয়াকত আলীর একটি পুকুরে যাওয়ার রাস্তা বাঁধছেন শ্রমিকরা। এখানে লেবার সর্দার আব্দুস সালামসহ ৩৫ জনের স্থলে ২৩ জন শ্রমিক রয়েছেন। শ্রমিকরা না আসলেও হাজিরা খাতায় তাদের হাজির দেখানো হচ্ছে। বড়খানপুর ওয়ার্ডে ৩৩ জনের জায়গায় ২১ জন শ্রমিক কাজ করছেন। হোগলডাঙ্গা গ্রামের মেম্বার আলী আহাম্মদ বলেন, ২০ জনের স্থলে ১৭ জন শ্রমিক কাজ করছেন। চাঁদপাড়া ওয়ার্ডে ৪৮ জনের জায়গায় ১১ জন মহিলাসহ ২৮ জন শ্রমিক কাজ করছেন। ইউপি মেম্বার লাল সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তেলে বেগুনে জ¦লে ওঠেন। বুন্দেলীতলা ওয়ার্ডে ২৬ জনের স্থলে কাজ করছেন মাত্র ৭ শ্রমিক। লেবার সর্দার জানান, তারা নিয়মিত ২০ জন কাজ করেন, একটু আগে ট্যাগ অফিসার এসে ঘুরে গেছেন। গত ৬ ডিসেম্বর সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের আন্দুলিয়া ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় ৫২ জনের স্থলে ২৫ শ্রমিক কাজ শেষ করে চলে যাচ্ছেন। আড়সিংড়ি পুকুরিয়া ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় ৩০ জনের স্থলে কাজ করছেন ২০ শ্রমিক। এ ব্যাপারে সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোতা মিয়া বলেন, সব ওয়ার্ডে ৫/৬ জন করে কম শ্রমিক রয়েছেন। ধুলিয়ানি ইউনিয়নের শাহাজাদপুর ওয়ার্ডের মেম্বার দাউদ হোসেন বলেন, ‘আগে সম্পূর্ণ কাজ করেও আমাকে অফিসে টাকা দিতে হয়েছে। তাই এবার এখনো কাজ শুরু করিনি। আগামী সপ্তাহের দিকে শুরু করবো।’ তিনি জানান, তার ইউনিয়নের অন্য ওয়ার্ডগুলোতেও একই অবস্থা। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতিয়ার রহমান ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। চৌগাছা সদর ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ডে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে কাজই শুরু করা হয়নি। এ ব্যাপারে সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজ চলছে ঢিলেঢালাভাবে, তবে এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত কোন ইন্টারেস্ট নেই। মেম্বারদেরকে বলে দিয়েছি কাজ যেমন করবেন তেমন বিল পাবেন।’