মহান বিজয় দিবস সংখ্যার একগুচ্ছ লেখা-২

0

জাপানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় এক গল্প
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

টোকিওতে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনকালে ১৯৯৯ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে প্রখ্যাত লেখিকা বেগম মুশতারী শফীর অনবদ্য রচনা ‘স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন’ বইটি আমার পড়ার সুযোগ হয়। বইটিতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোকে নিবিড়ভাবে ফিরে পেলাম যেন। মুক্তিযুদ্ধ আমার স্মৃতিতে আবেগ ও আলোড়ন সৃষ্টি করে। লেখিকা এমন বর্ণনা দিয়েছেন যা সত্যিই গদ্য মহাকাব্য হয়েছে। বইটিতে বেগম মুশতারী শফীর একান্ত ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে (রূঢ় বাস্তবের মোকাবিলা করে দেখা) মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো এমন নিখুঁত ও হৃদয়স্পর্শী বর্ণনায় উঠে এসেছে যে তা পাঠ শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামতে ইচ্ছে হয় না। বইটি শেষ করার পর মনে হলো যেন একটি উচ্চমার্গের তথ্যচিত্র দেখে উঠলুম। বছর তিন আগে প্রকাশনা সংস্থা মওলা ব্রাদ্রার্স জনাব এ এস মণ্ডল কৃত বইটির ইংরেজি অনুবাদ ‘উধুং ড়ভ গু ইষববফরহম ঐবধৎঃ’ প্রকাশ করেছে।
একটি মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন, সমৃদ্ধ-সৃজনশীল পরিবারের মর্মান্তিক বিয়োগব্যথা ও বেদনার বাস্তব কাহিনী দিনলিপি আকারে বইটিতে যেভাবে নিখুঁত ও মর্মস্পশী চিত্রনাট্যের মতো সাজানো হয়েছে তাতে একাত্তরের ঠিক ঐ সময় ও দিনগুলোকে যে কোনো পাঠক তার নিজের ব্যক্তিগত অবস্থানের দিনলিপির সঙ্গে মিলিয়ে নিতে বেশ একাত্মতাবোধ করতে পারেন। এমনটি হয়েই থাকে বিভিন্ন স্থানে অবস্থানগত কারণে একই সময়ে ঘটে যাওয়া প্রধান প্রধান ঘটনাবলির উপলব্ধির ক্ষেত্রে। মুশতারী শফী লিখেছেন তাকাশি ওয়াদা নামে এক জাপানির সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামে তৎকালীন ইস্টার্ন কেমিক্যালের ফ্যাক্টরিতে। বাওয়ানিদের ঐ ফ্যাক্টরিতে মি. ওয়াদার নেতৃত্বে জাপানি ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দল তখন কাজ করছিল। তার সম্পাদিত ‘বান্ধবী’ পত্রিকার জন্য রিপোর্ট তৈরি করতে মুশতারী শফী ইস্টার্র কেমিক্যালে গেলে জাপানি ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সে সুবাদে এক সময় তাকাশি ওয়াদা বাংলা সমাজ ও সংস্কৃতির অনুরক্ত ভক্ত হয়ে ওঠেন। মুশতারী শফী তাকাশিকে বাংলা বলা ও নিজের নাম লেখা শিখিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে ওয়াদা জাপানে ফিরে যান এবং তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল স্বামী প্রখ্যাত দন্ত চিকিৎসক ডা. মো. শফী এবং ভাই খন্দকার এহসানউল হক আনসারি পাকবাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর অত্যন্ত সংগোপনে ছেলেমেয়েদের নিয়ে মুশতারী শফী চট্টগ্রাম ছাড়েন এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক কষ্ট স্বীকার করে সীমান্তপাড়ি দিয়ে আগরতলায় পৌঁছান। সেখানে কিছুদিন আশ্রয় শিবিরে কাটানোর পর কলকাতায় যান ছেলেমেয়েদের নিয়ে। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে কাটতে থাকে তার দিনগুলো। মুশতারী শফী লিখেছেন ‘আজ দুপুরে আমার বন্ধু তাকাশি ওয়াদার চিঠি পেলাম, সঙ্গে ২০টি ইয়েন। একদিন আমার ব্যাগ ঝাড়তে গিয়ে তাকাশি ওয়াদার ঠিকানা পেয়ে যাই। ঠিকানা পেয়েই তাকাশিকে চিঠি লিখেছিলাম বাংলাদেশের সমস্ত ঘটনা জানিয়ে, সঙ্গে আমার জীবনের দুর্ঘটনার কথাও লিখেছিলাম।’ ও আজ লিখেছে ‘মুশতারী, তোমার চিঠি আমাকে ভীষণ রকম ব্যথিত ও মর্মাহত করেছে। বাংলাদেশের বাঙালিরা স্বাধীনতার দাবিতে যুদ্ধ করছে, এ কথা আমরা জেনেছি। কিন্তু এত যে নির্মম নৃশংসতা চলছে ওখানে, ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে, এত তো জানা ছিল না, আর দেশের জন্য তুমিও কিনা সেই নৃশংসতার শিকার হলে? ভাবতেও আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কী বলে যে তোমাকে সান্ত্বনা দেব, ভাষা নেই। ঈশ্বর তোমাকে শান্তি দিক। তোমরা যে ন্যায়ের অধিকারের সংগ্রাম করছ আমাদের দেশের সরকার ও জনগণ তোমাদের এই সংগ্রামের সপক্ষে রয়েছে। তোমার এই হৃদয়স্পর্শী চিঠিখানা আমাদের দেশের একটি ম্যাগাজিনে ছাপিয়ে দিয়েছি। আর তোমার এই দুর্দিনে বন্ধু হিসেবে সামান্য কিছু ইয়েন পাঠালাম। আশা করি গ্রহণ করবে। জানি না, ভারতীয় মুদ্রায় তুমি কত পাবে। তবে যাই পাও আমাকে জানাতে ভুলো না। সহসাই তোমাদের বিজয় কেতন উড়ুক। শুভ কামনায় তাকাশি ওয়াদা ২০/১১/৭১।’
৭১-এ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপানি জনগণের সহমর্মিতা প্রকাশ এবং সমর্থন দানের কথা আমরা অল্প বিস্তর অবহিত আছি।
জাপানি ইঞ্জিনিয়ার তাকাশি ওয়াদা বেগম মুশতারী শফীর ভারতের শরণার্থী শিবিরের দিনগুলোতে তাকে যে সান্ত্বনা সাহস আর অভয়বাণী পৌঁছিয়েছিলেন তা তো স্বাধীনতা আর মুক্তির সংগ্রামের প্রতি জাপানের জনগণের ও সরকারের আন্তরিক সমর্থনের প্রতীকী প্রকাশ। আমাদের দুর্দিনে তাদের এই পাশে দাঁড়ানোর হিম্মত, বদান্যতা ও ভালোবাসার প্রতি আমাদের সকৃতজ্ঞ সালাম জানানোর জন্যই মুশতারী শফীর বই পড়ার পর তাকাশি ওয়াদাকে আবিষ্কারের উদ্যোগ নিলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বন্ধুপ্রতিম জাপানি জনগণের দূতাবাসের সংরক্ষিত তালিকায় তার কোনো হদিস পেলাম না। মুশতারী শফীর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম দেড় দশকের মতো হলো তাকাশি-মুশতারীর মধ্যে যোগাযোগ নেই। আগে অন্তত নববর্ষে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাতেন তাকাশি ওয়াদা। মনটা ছ্যাঁত করে উঠল জাপানিরা নববর্ষে শুভেচ্ছা বিনিময়ে অত্যন্ত পাংচুয়াল। তাহলে তাকাশি কি বেঁচে নেই? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার এই সরব সমর্থকের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপনই আমার একান্ত ইচ্ছা। মুশতারী শফীর কাছ থেকে ওয়াদার পুরাতন ঠিকানাটাই জেনে নিলাম এবং সেই মতো যে কোম্পানিতে তিনি চাকরি করতেন সেই কোম্পানিটির সঙ্গেই যোগাযোগ করলাম। তারা জানালেন বছর বিশেক আগে তাকাশি অবসর নিয়ে কোম্পানি ছেড়েছেন। অনুরোধ রাখলাম তারা তার বর্তমান অবস্থানের আভাস দিতে পারেন কিনা। পাঁচদিন পর কোম্পানিটির ব্যবস্থাপক মি. সুজুুকি দিলেন একটি ফোন নম্বর; সম্ভবত এটি তাকাশির বাসার ফোন। অফিস আদালত থেকে জাপানিদের বাসায় সচরাচর ফোন করার কোনো রেওয়াজ নেই। আমার দোভাষী সহকর্মী ইসামু শিরাইকে বললাম তার পক্ষ থেকে যথারীতি ও সৌজন্য সহকারে তাকাশির বাসায় ফোন করতে। ফোন ধরেছিলেন তাকাশির স্ত্রী। বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে তার স্বামীর কেন খোঁজ করা হচ্ছে ভদ্রমহিলা বিব্রত ও কিছুটা বিরক্তও হলেন। শিরাই সাহেব সব বুঝিয়ে বলার পর তাকাশির বর্তমান কর্মস্থলের ফোন নম্বর পাওয়া গেল। এবার আমিই তাকে ফোন করলাম। তাকাশি ধরলেন। আমার পরিচয় দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম তার চট্টগ্রামের কথা, মুশতারী শফীর কথা মনে আছে কি না। এ যেন এক অভূতপূর্ব স্মৃৃতি মন্থনের অভিষেক। তাকাশি চমৎকার বাংলাতেই বললেন, ‘বেশ মনে আছে’। আমি তার কথা কীভাবে জানলাম পাল্টা প্রশ্ন এলো তার তরফ থেকে। তখন মুশতারী শফীর বইয়ের কথা বললাম। তাকাশির কাছ থেকে জানলাম তিনি কোম্পানি থেকে রিটায়ার্ড করার পর বর্তমানে একটি অনুবাদ সংস্থায় প্রশিক্ষক হিসেবে আছেন। জাপানিদের গড় আয়ু বিরাশি বছর। তাকাশির বর্তমান (১৯৯৯ সালে) বয়স আশি ছুঁই ছুঁই কিন্তু পুরো কর্মক্ষম আছেন এবং তাকে দেখলে বোঝা যাবে না তার এত বয়স হয়েছে। তাকে বললাম আপনাকে চাক্ষুস দেখতে চাই। আমার স্ত্রী পরের শুক্রবার ঢাকায় যাবেন। তার আগেই, শর্ট নোটিসে, তাকে সস্ত্রীক দাওয়াত দিলাম আমার বাসায় নৈশভোজে।
যে সময় তাকাশির সঙ্গে আমার ফোনে আলাপ হচ্ছে এবং তার ঐতিহাসিক আবিষ্কারের আবেগে আমি আপ¬ুত, ঠিক সেই সময়ে আমার রুমে ঢুকলেন কাজী গিয়াস উদ্দিন প্রখ্যাত চারুশিল্পী, চারুকলার ওপর জাপানে যিনি ডক্টরেট করেছেন এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার সুখ্যাতি রয়েছে। জানলাম মুশতারী শফী কাজী গিয়াসের ফুফু এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলা শরণার্থী শিবিরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যে সব তরুণ বেগম মুশতারী শফীর সঙ্গে সাক্ষাতে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে কাজী গিয়াসও ছিলেন। মুশতারী শফীর বইয়ে আছে, বেলাল মোহাম্মদের বইয়ে তো আছেই চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারে ‘মুশতারী লজ’-এই কালুরঘাটের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালুর স্বপ্ন বা প্রথম পরিকল্পনা উচ্চারিত হয়েছিল। বেলাল মোহাম্মদসহ বেতার কর্মীদের বেশ কয়েকজন মার্চের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে মুশতারী শফীর বাসাতে ছিলেন। এমনকি কালুরঘাট ট্রান্সক্রিপশন থেকে প্রথম দুই-তিনদিনের অনুষ্ঠান পরিচালনার পরিকল্পনাও ঐ বাসা থেকে নেওয়া হয়েছিল। মুশতারী শফীর পরিবারকে ৭ এপ্রিল যে চরম সর্বনাশের শিকার হতে হয় এবং বাচ্চাদের নিয়ে নিঃস্ব হয়ে তাকে ভারতে পাড়ি জমাতে হয়েছিল সবই এসব কারণে।
তাকাশি ওয়াদাকে আবিষ্কারের আনন্দে আমার সঙ্গে কাজী গিয়াসও অংশ নিলেন। তাকেও ঐ সন্ধ্যায় সস্ত্রীক দাওয়াত দিলাম। বললাম এটি হবে জাতির পক্ষে সকৃতজ্ঞ সৌজন্য প্রকাশের সুবর্ণ সুযোগ এবারের (১৯৯৯) বিজয় দিবসের প্রাক্কালে। তাকাশি ওয়াদা সস্ত্রীক এলেন সে সন্ধ্যায়। জাপানিরা সাধারণত স্ত্রীকে নিয়ে আসেন না দাওয়াতে। এটি ছিল ঘরোয়া অনুষ্ঠান এবং তাকাশির প্রতি নিবেদিত। কাজী গিয়াসও এলেন তার জাপানি স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের নিয়ে। তাকাশি হাতে করে এনেছেন মুশতারী শফী সম্পাদিত মাসিক ‘বান্ধবী’র ৪টি সংখা ১৯৬৮-৬৯ সালের। সে সময়ে চট্টগ্রাম (এখনকার বিবেচনায় নিতান্ত মফঃস্বল বলা যায়) থেকে এমন উচ্চাঙ্গের পত্রিকা (মহিলা লেখক, মহিলা সম্পাদক, মহিলা মুদ্রাক্ষরিক, কম্পজিটর সবই মহিলা) বের হতো দেখে বিস্মিত হতে হয়। ঐ পত্রিকাগুলোর একটিতে ইস্টার্ন কেমিক্যালসের ওপর বান্ধবীর সচিত্র প্রতিবেদন রয়েছে যেখানে উলে¬¬খ আছে তাকাশি ওয়াদার কথা। ওয়াদা সে অংশটি পড়তে পারেন আজও। কোনো যোগাযোগ না থাকলেও গত ত্রিশ বছরে তিনি ভোলেননি বাংলা। প্রথা ও রীতির ব্যতিক্রম ঘটিয়ে ওয়াদা ও কাজী গিয়াস তাদের স্ত্রীদের নিয়ে রাত একটা অবধি সেদিন আমাদের বাসায় ছিলেন। ইতিমধ্যে কয়েকবার চেষ্টা করলাম ফোনে চট্টগ্রামে মুশতারী শফীর সঙ্গে তাদের আলাপ করিয়ে দেওয়ার চমক সৃষ্টি করতে। কিন্তু তা আর হলো না মুশতারী শফীর ফোনটা সেদিন খারাপ ছিল। যা হোক আসন্ন বিজয় দিবসে তাকাশি ওয়াদাকে দূতাবাসে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানানোর অভিপ্রায় নিয়ে সেদিনের নৈশভোজ ও স্মৃতি সম্মেলন শেষ হলো। অনেক ছবি তোলা হলো। যা চলে যাবে মুশতারী শফীর কাছে আমার তরফ থেকে আর ওয়াদার তরফ থেকে তো বটেই।

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের শত্র“ ছিল
আফসান চৌধুরী

পাকিস্তান আর্মি ১৯৭১ সালে খুব কম ক্ষেত্রেই নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায়। প্রায় প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পেছনে একটা পরিকল্পনা ছিল, লক্ষ্য ছিল। সেটা ২৫ মার্চের রাত থেকেই লক্ষ করা যায়। যারা গণহত্যা নিয়ে কাজ করেন, তারা সাধারণত লক্ষায়িত শত্র“হত্যা এবং নির্বিচারে হত্যার একটা তফাত টানেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা যাদের নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে দেখি, তার চেয়ে অনেক বেশি পাকিস্তানের কাছে যারা শত্র“ হিসেবে চিহ্নিত, তাদের হত্যাকাণ্ডের উলে¬খ বেশি পাই। যেসব মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তার মধ্যে একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে যাদের নিধন করার পরিকল্পনা করা হয়, তার মধ্যে বুদ্ধিজীবীরা অন্যতম প্রধান গোষ্ঠী।
২৫ মার্চের রাতে হত্যাকাণ্ডের কয়েকটি লক্ষ্য চিহ্নিত করা যায়। এক. পিলখানা ও রাজারবাগ। অর্থাৎ যেখান থেকে পাকিস্তানিরা সশস্ত্র প্রতিরোধ হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিল। দুই. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো, বিশেষ করে ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) এবং জগন্নাথ হল। ইকবাল হলে অবস্থান করতেন রাজনৈতিক কর্মীরা এবং জগন্নাথ হল টার্গেট করার কারণ ছিল ওখানে ছিল হিন্দু ছাত্ররা। তিন. ঢাকার বিভিন্ন বিস্তসমূহ, যার অধিবাসীদের পাকিস্তানিরা ভয় ও ঘৃণা করত। তাদের লেখাতে উলে¬খ পাওয়া যায় এই বিষয়টি। মিছিলের সামনের মুখগুলোকে তারা বিস্তবাসী মানুষ বলেই চিহ্নিত করত। বিশেষভাবে লক্ষায়িত কয়েকটি হত্যাকাণ্ড তারা চালায়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন এবং পরে ভাষাসৈনিক ধীরেণ দত্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই লক্ষায়িত গোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ যেসব শিক্ষককে তারা চিহ্নিত করেছিল রাজনৈতিক মতাদর্শের নেতা হিসেবে বা যারা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজনকে। এর মধ্যে আবার তেমন নামও পাওয়া যায় যিনি কোনোভাবেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। যেমন– প্রফেসর গোবিন্দচন্দ্র দেব। আবার সব শিক্ষকের ওপর আক্রমণ করা হয়নি। অতএব মোটাদাগে বলা যায় শিক্ষকরা তাদের শত্র“ ছিল এবং তাদের ভেতরে আবার কিছু মানুষকে তারা বড় শত্র“ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তার মানে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক হত্যা শুরু হয়েছে ২৫ মার্চ রাত থেকেই এবং এটা পরিচালনা করে পাকিস্তান আর্মি। যুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে ১৪ ডিসেম্বর আবার হত্যাকাণ্ড চালায়। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের হত্যাকারীরা প্রধানত ছিলেন এ দেশের মানুষ। যদিও পরিকল্পনা পুরোটা করেছিল পাকিস্তানিরা। এই পরিকল্পনা থেকে বোঝা যায় বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানিরা বিশেষভাবে শত্র“ হিসেবে দেখত।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বাংলাদেশের জন্মের কয়েকটি সূত্রস্থান খুঁজে পাওয়া যায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য ঢাকা এবং অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। যেহেতু সংস্কৃতিচর্চা এবং রাজনীতির সঙ্গে তার সম্পৃক্তকরণ এই পরিসরেই ঘটেছে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ১৯৪৮ সালের বক্তৃতা যদি পাঠ করা হয় তাহলে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়। জিন্নাহর মূল দুর্ভাবনা ছিল প্রধানত তিনটি। এক. এই অঞ্চলে, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিকতার মনোভাব জন্মলাভ করছে। দুই. এখানকার তরুণরা ভারতের কথায় অনেক বেশি উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, যেগুলো তিনি মিথ্যাচার বলে আখ্যায়িত করেন। তিন. মুসলিম লীগকে সমর্থন না করলে পাকিস্তানের উন্নতি সম্ভব নয়। এরপর তিনি সরাসরিভাবে হুমকি দেন, যদি এই গুণ্ডামি-বদমাইশি বন্ধ না করা হয় তাহলে রাষ্ট্র তার সব শক্তি দিয়ে সেটাকে প্রতিহত করবে।
এ কথা থেকে বোঝা যায়, পাকিস্তান একক রাষ্ট্র হিসেবে সম্ভবত কোনো দিনই জন্মলাভ করেনি। কারণ, পূর্ব পাকিস্তান/পূর্ববাংলা জন্ম থেকেই স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের সব চরিত্র ধারণ করেছিল। জিন্নাহার সব সময় ভয় ছিল যে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়বে এবং তাদের তিনি বারবার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ রেখে নানা ধরনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে, বদমানুষের কথা না শুনতে। একটি সদ্যসৃষ্ট রাষ্ট্রের প্রধান এতটা কেন নার্ভাস ছিলেন সেটা সহজে বোঝা যায় না, যদি আমরা ইতিহাসের দিকে না তাকাই, পূর্বের এবং পরের। জিন্নাহ বাংলাদেশের তরুণদের সরকারি চাকরি না করে আরও বিভিন্ন কাজ করতে বলছিলেন এবং দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, তরুণরা কেন শুধু সরকারি চাকরি চায়। জিন্নাহর দুশ্চিন্তার প্রাবল্য তার বক্তৃতার মধ্যেই রয়েছে।
১৯৪৮ সালে যখন জিন্নাহ ঢাকায়, তত দিনে ভাষা-আন্দোলন রাজনৈতিক চরিত্র ধারণ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক এই আন্দোলন পরবর্তীকালে আরও বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৯ সালের দিকে যখন সংবিধানের মূলনীতির বিষয়ে প্রস্তাবনা রাখা হয়, তখন উদুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা উলে¬খ করা হয়। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়ে যায় এবং ক্রমেই বড় আকার ধারণ করতে থাকে। অতএব পাকিস্তানের ক্ষমতাবানদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব সময় দুর্ভাবনার স্থান ছিল। ১৯৫২ সালে যখন ভাষা-আন্দোলনের মিছিলে গুলি করা হয়, তত দিনে এটি একটি কেন্দ্রীয় বিদ্রোহের পরিসর হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। ৫২ থেকে ৫৪ খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। যেহেতু এ সময় রাজনৈতিক দল এবং শক্তিসমূহ একত্র হয়ে আন্দোলন শুরু করে। যেটি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি থেকে মুসলিম লীগের বিদায়ঘণ্টা বাজায়। অর্থাৎ জিন্নাহর দল কোনো দিনই পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে শান্তিতে পা রাখতে পারেনি।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে মার্শাল ল জারি হয় রাষ্ট্র বাঁচানোর একটি চেষ্টা হিসেবে। সেই ধারাবাহিকতায় নতুনভাবে এর বিরুদ্ধেও আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশনকে কেন্দ্র করে ছাত্র আন্দোলন পাকিস্তানকে সাংঘাতিকভাবে নাড়া দেয় এবং ৬৯-এর আন্দোলনের প্রস্তুতি তখন থেকেই শুরু হয়ে যায়। ৬৯-এর আন্দোলনের বিশেষত্ব হচ্ছে যে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যারা সাধারণত সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে পছন্দ করে, তারাই প্রধান বিদ্রোহীশক্তি হিসেবে উন্নীত হয়।
১৯৬৬ সালের ৬ দফাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের ১১ দফা আন্দোলন তৈরি হয়। যেটি শেষপর্যায়ে এসে আইয়ুব খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তার বদলে নতুন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসে এবং ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন দেয়। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। যার প্রতি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষকদের পূর্ণ সমর্থন ছিল। একই সঙ্গে এই বুদ্ধিজীবীরাও সক্রিয় রাজনীতির সহায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়।
কিন্তু আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবকে ক্ষমতা দেওয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে অসম্ভব ছিল। যেহেতু পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিছুদিন আগে তাকে ভারতীয় চর হিসেবে চিহ্নিত করেছিল এবং প্রধান শত্রু হিসেবে ভাবত। পাকিস্তান রাষ্ট্রকে রক্ষা করার প্রয়োজনে পাকিস্তানিদের আক্রমণ অবধারিত হয়ে ওঠে। ২৫ মার্চ রাতে যেসব জায়গায় হানা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো যদি চিহ্নিত করা হয় এবং ১৪ ডিসেম্বর যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের পরিচয়গুলো লক্ষ করা যায়, তাহলে এটা বোঝা সহজ যে, তাদের মেধাবী হিসেবে যতটা না, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে নিরবচ্ছিন্নভাবে দুর্বল করার পেছনে তাদের যে ভূমিকা সেটাই ছিল তাদের প্রধান অপরাধ। সে কারণেই বুদ্ধিজীবী দিবস বৃহৎ রাজনীতির যে ধারা, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম তার একটি অংশ। এখানেই অনেকেই ভূমিকা রেখেছেন। অতি সাধারণ প্রান্তিক মানুষসহ। আমরা যেমন বুদ্ধিজীবীদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাই এ দিবস পালন করে, ঠিক তেমনিভাবে এ দেশ সৃষ্টির পেছনে যেসব শ্রেণিপেশার ও জনগোষ্ঠীর মানুষের ভূমিকা রয়েছে, তাদের সবাইকে শ্রদ্ধা জানানো আমাদের দায়িত্ব।
লেখক
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, শিক্ষক ও সাংবাদিক
[সংকলিত]

১৯৭১: নারীর ইতিহাস কেন বাদ পড়ে যায়
আফসান চৌধুরী

বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চা থেকে নারী অনেকটা বাদ পড়ে আছে। এটি বিশেষ করে লক্ষ করা যায় ১৯৭১-এর ইতিহাসের ক্ষেত্রে। এর একটি কারণ হতে পারে যে, নারী সমাজের অংশ ঠিকই, কিন্তু ইতিহাসের স্বীকৃতি সমাজের দিকে যায়নি, গেছে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর দিকে। যেহেতু নারী ক্ষমতার বলয়ের অংশ নয়, বিশেষ করে ৭১-এর ইতিহাসে, তাই তার ভূমিকা বাদ পড়ে যায়
বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চা থেকে নারী অনেকটা বাদ পড়ে আছে। এটি বিশেষ করে লক্ষ করা যায় ১৯৭১-এর ইতিহাসের ক্ষেত্রে। এর একটি কারণ হতে পারে যে, নারী সমাজের অংশ ঠিকই, কিন্তু ইতিহাসের স্বীকৃতি সমাজের দিকে যায়নি, গেছে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর দিকে। যেহেতু নারী ক্ষমতার বলয়ের অংশ নয়, বিশেষ করে ৭১-এর ইতিহাসে, তাই তার ভূমিকা বাদ পড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে গবেষণা করতে গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে, যেভাবে আমরা ক্ষমতাকে দেখি বা উপভোগ করি, সমাজকে স্বীকৃতি দিই তার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে নারীর ভূমিকা বাদ পড়ে যাওয়ার আসল কারণ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় যাদের কথা উঠে আসে তারা হচ্ছে রাজনীতিবিদ, সৈনিক এবং বিভিন্ন শ্রেণির আমলা। অর্থাত্ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একধরনের সরকারিকরণ ঘটেছে। যার মাধ্যমে এই গোষ্ঠীসমূহের বয়ানের ওপর ভিত্তি করে ইতিহাসচর্চা হচ্ছে। সরকার ও সমাজের এই ব্যবধান ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।
এই ব্যবধান রক্ষা করার সচেতন ও অবচেতন দুই চেষ্টাই রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, যদি সীমাবদ্ধ পরিসরে স্বীকৃতির বিষয়টি থাকে তাহলে প্রাপ্তির বিষয়টিও অনেক সহজে ফয়সালা হয়ে যায়। স্বীকৃতি মানেই অধিকার এবং দাবি। আর নারীর ভূমিকা স্বীকৃতি দেয়া মানে হলো সমাজের স্বীকৃতি দেয়া। অতএব, যুদ্ধপরবর্তী চাওয়া-পাওয়ার হিসাবে এত অংশীদার হয়ে যেতে পারে যে সবাইকে ভাগ দিতে গেলে তাদের পাতে বেশি কিছু পড়বে না। এই সুবিধার পরিসরকে রক্ষা করার ন্যূনতম পথ হচ্ছে স্বীকৃতির পরিসরকে ছোট করে রাখা। সব স্বীকৃতির ক্ষমতা সরকারের হাতে। তাই সব সুবিধা প্রদানের সুযোগ তাদের হাতেই। এ কারণেই সমাজের স্বীকৃতিদানের প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থা করার ব্যাপারে কারো আগ্রহ নেই। যতদূর সম্ভব সচেতনভাবে নিয়মকানুনের মাধ্যমে যদি ভূমিকা এবং স্বীকৃতির তালিকাকে ছোট রাখা যায় সেটা সুবিধাভোগীদের জন্যই সুফল বয়ে আনবে।
ইতিহাসে তাই সুবিধাবঞ্চিতদের কথা খুব একটা বলা হয়নি। আমাদের মূলধারার ইতিহাসচর্চা পূর্বোল্লেখিত কারণে সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্তদের ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। এই কারণেই মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটের এত দাম এবং এটা নিয়ে এত রাজনীতি হয়। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধারা দাবি করতে পারে স্বাধীনতা কেবল তারাই এনেছে, তাই সশস্ত্র হওয়াটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ বলতে কী বোঝায় সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। কারণ অস্ত্রের ভূমিকা কী আর নিরস্ত্র মানুষের ভূমিকা কী—তার সমঝোতা এখনো হয়নি ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা বলতে, কেবল সশস্ত্র ব্যক্তিদের বুঝিয়েছে। সহজ সমীকরণে মুক্তিযুদ্ধ মানেই মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধা মানেই ক্ষমতা। এই সমীকরণে সমাজের কোনো ভূমিকা নেই। থাকলেও তা গৌণ। এই গৌণ ভূমিকার পরিসরে নারীর ভূমিকা আরো গৌণ হয়ে পড়েছে। তার ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা বা তথ্য সন্ধান করার কোনো আগ্রহ সাধারণ মানুষ এবং ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে নেই। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ যে একই কথা, তাও মানুষ ভাবতে পারছে না।
আমরা যখন ’৭১ সালের ত্যাগের কথা বলি, তখন সাধারণ মানুষের ত্যাগের বিষয়টি তেমন একটা আলোচনা হয় না বললেই চলে। এই ত্যাগের পরিসরকে ছোট করে ফেলা সহজ হয় যদি ‘ত্যাগ করার যোগ্যতা’ বিশেষ একটি বা দুটি অংশের হয়। তাই দেখা যায়, যে নারী নয় মাস ধরে সব বিপদ মাথায় রেখে পুরো সময় সবাইকে সাহায্য করেছে, সংসার বাঁচিয়েছে, সমাজ বাঁচিয়েছে, এক কথায় এমন একটি পরিসর সৃষ্টি করতে পেরেছে যাতে করে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করতে পারে বা যৌথবাহিনী প্রবেশ করতে পারে। তাকে স্বীকৃতি দেয়ার জ্ঞান-শিক্ষা বা ইচ্ছা কোনোটিই আমাদের মাঝে নেই। এমনিতেই আমরা অস্ত্র দেখে নিজেকে বীর ভাবতে অভ্যস্ত। কিন্তু যে নারী গোটা সমাজকে রক্ষা করে—তাকে আমরা অবহেলা করছি যুগ যুগ ধরে। আমরা জানিও না কীভাবে তাকে স্বীকৃতি দিতে হয়। কীভাবে তার গৌরবগাথা বলতে হয়, গাইতে হয়।
আমাদের ইতিহাসচর্চায় সশস্ত্র বা রাজনৈতিক পরিসরে কে কী করেছে সে বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু সামাজিক পরিসরে কী হয় সেটা আমরা জানি না। লক্ষ করলে দেখা যাবে, যেসব সূত্র থেকে এ তথ্য আসে সেগুলো সবই সমাজের ওপরতলার মানুষের দখলে। এই তথ্যের পরিসরকে বড়জোর সে পর্যন্ত নেয়া যায়, যেখানে কোনো ভূমিকা কেউ রেখেছে সে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর সহায়ক হিসেবে। এর ফলে ইতিহাসে তার ভূমিকা প্রান্তিক থাকে। যেহেতু সাধারণ নারীসমাজ রাজনীতিও করেনি এবং অল্প কজন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, আমাদের গৌণকরণ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারীর ভূমিকা। আমরা যে তাকে পরিচয় বা স্বীকৃতি দিতে জানি না তা-ই নয়, আমরা আসলে তাকে দিতেও চাই না। এই না দিতে চাওয়ার মূল সূত্রই হচ্ছে, একটি জাতির স্বাধীনতা বা মুক্তিতে গোটা সমাজের ভূমিকা থোকে কি না, তা মেনে নেয়া বা না নেয়া।
যদি আমরা মনে করি, এটি কেবল নেতৃবর্গের বা নেতৃত্বদানকারী বা ক্ষতাবানদের কারণে ঘটেছে, তাহলে নারীর ইতিহাসও লেখা হবে না এবং সামাজের ইতিহাসও কেউ জানতে পারবে না। আমরা যখন ইতিহাসের তথ্য অনুন্ধান করি, তখন শুধু সশস্ত্র যুদ্ধের তথ্যই সংগ্রহ করে থাকি। কিন্তু সমাজের সংগ্রামের কথাকে তেমন একটা গুরুত্ব দিই না। এর ফলে আমাদের তথ্যভাণ্ডারেও এর তেমন কোনো উদাহরণ জমা পড়েনি। তাই ইতিহাসচর্চার প্রথম পদক্ষেপ ‘তথ্য সংগ্রহ’ সেটিই করা হয়নি বাংলাদেশের ইতিহাসে।
পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশেই এটা হয়নি। কারণ, অন্য দেশের অবস্থাও ব্যতিক্রম। অর্থাত্ ক্ষমতবানদের দখলেই ইতিহাসচর্চা থেকেছে সবসময়। যাতে করে ইতিহাসের ‘লাভের গুড়’ তারাই পায়। ইউরোপের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ যুদ্ধ ছিল সম্মুখযুদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পুরো দেশজুড়ে। খুব কম দেশে এরকম একটি পরিস্থিতি হয়—যেখানে হাজার হাজার গ্রাম অংশগ্রহণ করেছে তাদের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পরিসরে। কিন্তু ইতিহাসচর্চা করতে গেলে অনেক ইতিহাসবিদ এখনো যুদ্ধ-সংঘাতের খবর নেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ কীভাবে একাত্তর পার করেছিল, কীভাবে সমাজ টিকিয়ে রেখেছিল—সে কথা জানতে চান না। সমাজের কথা না জানলে নারীর খবর জানা সম্ভব নয় এ খুব সহজ সত্য।
যে ক্ষেত্রে আমরা নারীর ভূমিকা উল্লেখ করতে চাই, সেটি তখন তার নির্যাতিত হওয়ার অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীর প্রধান ভূমিকা হচ্ছে, একজন নির্যাতিত অসহায় মানুষ হিসেবে। সে বারবার পুরুষের লালসার শিকার হচ্ছে, পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে, কখনো পারছে, কখনো পারছে না। এমনকি নির্যাতিত হওয়ার পর সামাজিকভাবে গঞ্জনার শিকার হতে হয়েছে তাকে। কালেভাদ্রে দু-একজন অস্ত্রধারী নারীকে পাওয়া গেলে তার কথা বলা হচ্ছে, কারণ ওই নারী ‘পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছে’। অর্থাত্, পুরুষ যেটা করেছে, সে তাকে কোনোভাবেই ইতিবাচক স্বীকৃতি দেয়নি। নারী নির্যাতন, তার প্রধান বাস্তবতা এবং এর বাইরে দু-এক স্থানে সে পুরুষের পাশে দাঁড়ানো সহযোদ্ধা। এই প্রান্তিকরণ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ারই অংশ, যাতে কেবল নারী নয়, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বা সমাজের প্রায় সব মানুষ পড়ে যায়। অর্থাত্, সেসব মানুষ বা গবেষক ইতিহাসচর্চায় ভূমিকা রাখার অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। সরকারের সঙ্গে সংযুক্ত হলেই বোধ করি কোনো ভূমিকা পালনের অধিকার জন্মাবে তাদের।
একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই, যেটি আমাদের সাধারণ মানুষের ভূমিকা সম্পর্কে সামান্য ধারণা দেবে। কুমিল্লার একটি নদী পার হচ্ছিল একদল হিন্দু শরণার্থী। নৌকা না পেয়ে তারা কচুরিপানা সংগ্রহ করে একে ভেলা হিসেবে ধরে ধরে পার হচ্ছিল হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে। ওই দলের মধ্যে একজন মা ছিলেন, সঙ্গে ছিল ছোট্ট শিশু। যেহেতু অনেক মানুষ কচুরিপানার ভেলাটি ধরেছিল, তাই পানির নিচে চলে গিয়েছিল। মহিলাটি এই অবস্থা দেখে চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে থাকেন। এক হাতে তার সন্তান, অন্য হাতে ভেলাটি ধরা। এই অবস্থায় নড়াচড়া চিৎকার সবাইকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দেয়। আশঙ্কা ছিল, আওয়াজ শুনে পাকিস্তানের আর্মি বা রাজাকাররা চলে আসতে পারে। ওই মহিলার পাশে ১৪/১৫ বছরের একটি মেয়ে ছিল। ওই মেয়েটি মহিলাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু মহিলার কিছুতেই ভয় কাটছিল না। তখন ওই মেয়েটি ভার কমাবার জন্য নিজের হাত ছেড়ে দিয়ে পানির নিচে তলিয়ে যায়। ভেলার সবাই নিরাপদে পৌঁছেছিল শুধু সেই মেয়েটি ছাড়া। এরকম অসংখ্য ঘটনা ৭১-এ ঘটেছে। কিন্তু তার কোনো উল্লেখ নেই, স্বীকৃতি নেই, মানুষের মাঝে চর্চা নেই। আমরা যত দিন এই মেয়েটিকে আমাদের শ্রেষ্ঠতম মানুষের একজন বলে সম্মান দিতে না পারব, যতদিন তাকে মুক্তিযোদ্ধা বলে স্বীকৃতি দিতে না পারব—ততদিন পর্যন্ত নারীর ইতিহাস বা সমাজের ইতিহাস উপেক্ষিতই থেকে যাবে। সম্ভবত উপেক্ষার মেঘ কেটে কখনোই সূর্য হাসবে না আমাদের ইতিহাসের সোনালি আকাশে।

মুক্তিযুদ্ধের ছবি
শহিদুল আলম

একাত্তরে আমার বয়স কম ছিল। ফলে যুদ্ধের ছবি তোলার সৌভাগ্য হয়নি। পরে যখন মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র নিয়ে কাজ শুরু করি, তখন খুব অবাক হতে হয়। এত বড় একটা ঘটনা, তার উপর তেমন কোনো প্রামাণ্য দলিল নেই! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা, চলচ্চিত্র, প্রামাণ্য দলিল, আর্কাইভ—এমন অনেক কিছু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। যাহোক, মুক্তিযুদ্ধের ছবি সংগ্রহ করতে গিয়ে যা প্রথমে আমাদের চোখে পড়ে, তা হলো, কিশোর পারেখের অ্যালবাম। ওই বইটি কিছুদিন আগে আবার প্রকাশিত হয়। তারেক মাসুদ কিছু সংগ্রহ থেকে একটা ফিল্ম তৈরি করেছিলেন।
তো আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা শুরু করি। এরই অংশ হিসেবে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ছবি দিয়ে একটা ক্যালেন্ডার প্রকাশ করি। সেখানে রশীদ তালুকদার, আফতাব আহমেদ, জালাল উদ্দিন হায়দার, মোহাম্মদ শফি, মঞ্জুর আলম বেগ এবং মঞ্জুর আলম বেগের ভাই ক্যাপ্টেন বেগ যিনি নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাঁদের ছবি ছিল। এখানে বলে রাখি, ক্যাপ্টেন বেগ অপারেশন চলাকালীন অনেক ছবি তুলেছিলেন। তিনি যেহেতু নিজে যুদ্ধের ফিল্ডে ছিলেন। ফলে তাঁর যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি তোলা সম্ভব হয়েছিল। ক্যালেন্ডারের প্রচ্ছদে রশীদ তলুকদারের বুদ্ধিজীবি হত্যার সেই অসাধারণ ছবিটা ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি সেই সময়কার মর্মস্পর্শী লেখাগুলোর কিছু অংশও বেছে নেয়া হয়েছিল। এছাড়া আমরা বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা, কবিতা ইত্যাদিও সংগ্রহ করি। সেই সময়ে আর কারা কারা কাজ করেছিলেন আমরা তখন তা জানতামও না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা শুরু করলে বিষয় আমাদের চোখে পড়ে। বাংলাদেশে যে আলোকচিত্রীরা কাজ করতে এসেছিলেন তার যদি একটা তালিকা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, আলোকচিত্র-জগতের কিংবদন্তি ফটোসাংবাদিক যাঁরা ছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই এদেশে যুদ্ধের ছবি তুলতে এসেছিলেন। এটা একটা অবাক বিষয়।
এ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ১৯৯৪ সালে প্যারিসে সিপা এজেন্সির কর্ণধারের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে মুক্তিযুদ্ধের উপর একগাদা রঙিন স্লাইড নিয়ে আসেন। তখনও পর্যন্ত আমি একাত্তরের ছবির রঙিন স্লাইড দেখিনি। এইসব ছবি দেখে আমি ভড়কে যাই। মুক্তিযুদ্ধ রঙিন রূপে তাতে ফুটে আছে। ছবিগুলো তোলা ছিল আব্বাস নামের একজন ইরানি আলোকচিত্রীর। উনি একমাত্র আলোকচিত্রী যিনি পাকিস্তান এবং ভারত—দুই দিকের ছবিই তোলেন। পরে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার পরের ছবি, ক্যাপ্টেন বেগের ছবিগুলো দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছিল। রবার্ট ব্লেস নামের একজনের দেড় লক্ষ নেগেটিভ থেকে বাছাই করে আমরা একটা অসাধারণ সংগ্রহ জোগাড় করি।
এ কাজ করতে গিয়ে আলকচিত্রীরা সহযোগিতা পেয়েছি খুব। একেকজনের সঙ্গে দেখাও হয়েছে কাকতালীয়ভাবে। তাদের একজন ডন মেককালিন। উনার সঙ্গে দেখা হয় আর্ল আলোকচিত্র ফেস্টিভালের এক পার্টিতে। তিনি নিজ হাতে ছবি প্রিন্ট করে আমাকে পাঠান। আব্বাসকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমরা দুজনেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরছি। ফলে কোনোমতেই দেখা হচ্ছে না। ম্যানিলায় যখন গিয়েছি, সমুদ্রের ধারে সন্ধ্যার দিকে সূর্য ডুবছে, আঁকাবাঁকা নৌকার একটা ভালো ফরমেশন ছিল, সেখানেই পেলাম আরেক দাড়িওয়ালা ফটোগ্রাফারকে। তিনিও আমার মতো সূর্য ডুবার দৃশ্য ধারণ করছেন। পরিচয় হলো, জানলাম তিনিই আব্বাস!
প্রত্যেকেই খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছবি দিয়েছে। অনেক জায়গা থেকে বিভিন্নভাবে ছবি জোগাড় করি। এরপর আমরা জাদুঘরে প্রথম ছবিমেলার আয়োজন করি। সেই সময়ে আমরা পুরো গ্যালারিতে ফল্স ওয়ালে প্রদর্শনীর ডিজাইন করি। আমরা চাচ্ছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক দিক নিয়ে একটা প্রদর্শনী করতে। সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রদর্শনীতে সরকারি সেন্সরশিপটা ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না। কারণ, আমরা চাচ্ছিলাম সব ছবিরই প্রদর্শনী হোক। পরের দিন তিনটায় আমাদের প্রদর্শনী শুরু হওয়ার কথা ছিল, জাতীয় জাদুঘরে। কিন্তু পরে সাংবাদিক বন্ধুসহ সবাইকে জানিয়ে দিলাম এখানে প্রদর্শনী হচ্ছে না। তড়িঘড়ি করে দৃক গ্যালারিতে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হলো। কবি শামসুর রহমানসহ যাঁদের জাদুঘরে উদ্বোধন করার কথা ছিল, তাঁরা সবাই দৃক গ্যালারিতে এসেছিলেন। এটা ছিল আমাদের শুরু। পরে বাংলাদেশের অন্যান্য আলকচিত্রীদের কাজও সংগ্রহ করেছি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশি আলোকচিত্রীদের কাছ থেকে ছবি নিয়ে লন্ডনের বিখ্যাত একটা জাদুঘরে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাছেও ছবি সংগ্রহের কোনো আর্কাইভ নেই, শিল্পীর নাম নেই, একেক ছবিকে একেকভাবে ক্রপ করে অপমানজনকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। আলোকচিত্রীর যথার্থ সম্মানটুকু দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সঙ্গে এমন প্রামাণ্য দলিল সংগ্রহে সহযোগিতা আশা করব।