স্মার্টফোনের বিকিরণ যেভাবে ক্ষতি করে

    0

    লোকসমাজ ডেস্ক॥ করোনা ভাইরাস এসে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, ডিজিটাল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে স্মার্টফোন, ওয়াইফাই ছাড়া চলা মোটেও সম্ভব নয়। হাতে হাতে দিন-রাত স্মার্টফোনে চলছে প্রযুক্তির চমৎকার ডিজিটাল ম্যাজিক! স্মার্টফোন ছাড়া এখন কারো এক মুহূর্ত চলে না। চারপাশে চোখ মেলে তাকালে অন্ধকারেও চোখে পড়ে নীলাভ আলো। মানে স্মার্টফোনে কাজ হচ্ছে। কল করা, মেসেজ পাঠানো, ছবি শেয়ার করা, হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুকসহ কত কিছু করা যায় স্মার্টফোন থেকে! খেতে খেতে, হাঁটতে হাঁটতে, শুয়ে শুয়েও চলছে স্মার্টফোন। সব সময় সঙ্গে থাকছে স্মার্টফোন। স্মার্টফোন ক্রমশই অন্তজীবন হয়ে উঠছে সবার।কখনো কি ভেবেছেন? এই যে মানুষগুলো বাস্তব বহিঃজগতের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে স্মার্টফোন নিয়ে বুঁদ হয়ে রয়েছেন। এদের ইন্দ্রিয়ের সবটাই দখল করে নিচ্ছে স্মার্টফোনের সব কেরামতি। তাই আশঙ্কা বেড়েছে, স্মার্টফোনের অতিরিক্ত এই সুখ, অজান্তে না জানি ডেকে আনে অন্য কোন অসুখ? আমজনতার মনে প্রশ্ন জেগেছে, সারাক্ষণ স্মার্টফোন ব্যবহার করলে কি ক্যান্সার হয়? স্মার্টফোনের গেম খেলা, সিনেমা দেখায় কি চোখ নষ্ট হয়ে যায়? জ্বি না। বৈজ্ঞানিক ধারণা দিয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো একশ শতাংশ সঠিক বলা সম্ভব নয়। তবে একথা সত্য, স্মার্টফোন তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়। এর নীল বিষাক্ত বিকিরণ মস্তিষ্কে আঘাত হানে।
    স্মার্টফোনের নীল বিকিরণ!
    স্মার্টফোনকে বলা হয় অ্যান্ড্রয়েড পিসি। এটা শুধু গ্রাহক যন্ত্র ও প্রেরক যন্ত্র নয়। বরং নানাবিধ অনলাইন ভিজ্যুয়াল সুযোগ-সুবিধাযুক্ত এক সমন্বিত ডিভাইস। স্মার্টফোনকে নিয়ন্ত্রণ করে নিকটবর্তী ওয়াইফাই বেইজ স্টেশন বা ট্রান্সমিটার। স্মার্টফোনের সুইচ অন করার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে ওঠা নীলাভ আলো বিশ সেকেন্ডের মধ্যে নিকটবর্তী ওয়াইফাই, ব্লুটুথ ও ট্রান্সমিটার; এমনকি অন্য স্মার্টফোনকে বৈদ্যুতিক সঙ্কেতের মাধ্যমে জানান দেয়- ‘আমি এখানে রয়েছি’।বিভিন্ন দরকারি অ্যাপ, স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাইন ইন হয়ে নির্দেশের অপেক্ষায় সারাক্ষণ নীল আলোর সংকেত দিয়ে যায়। ঘরের মধ্যে থাকা অন্যসব গ্যাজেট- (ওয়াইফাই মডেম, রাউটার, পিসি, অ্যান্ড্রয়েড টিভি) নীল আলোর সংকেত দিয়ে আপন মনে খোঁজ করে স্মার্টফোন বা পাশের অন্য যন্ত্রকে। এই নীল রঙের অদৃশ্যমান আলোর বিকিরণ এখন বিজ্ঞানীদের কপালে ভাঁজ তুলেছে। কারণ কী? এই নীল আলো ঘরের বাতাসকে দূষিত করে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘স্মার্টফোনের এই নীল বিকিরণ নানা ক্ষতি করছে মানবদেহে। বিশেষ করে, তরুণদের শরীরে ক্ষতির প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি। এজন্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে গর্ভবতী মায়েরাও।’
    নীল আলোয় কী আছে?
    স্মার্টফোনের পর্দা একধরনের উজ্জ্বল নীলাভ আলো নিঃসরণ করে। যা দিনের কড়া আলোয়ও ফোনের পর্দা স্পষ্টভাবে দেখতে সাহায্য করে। এর নাম সায়ান। সহজ করে বলতে গেলে, সবুজ আর নীল মেশালে যে রং হয় সে রকম। বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘এ রঙের মধ্যে এমন এক গোপন উপাদান রয়েছে, যেটা এক ঝটকায় মানুষের ঘুম তাড়িয়ে মস্তিষ্ককে সজাগ করে তুলতে পারে। এ নীল আলো মস্তিষ্কে মেলাটোনিন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। আর মেলাটোনিন এমন এক হরমোন; যা শরীরকে ঘুমের সংকেত দিয়ে বলে দেয়: ‘যাও বিছানায়! এখন তোমাকে ঘুমোতে হবে’। অথচ স্মার্টফোনের উজ্জ্বল স্ক্রিনের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার কারণে নিদ্রাচক্র ব্যাহত হচ্ছে। যা শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ বৈকি!
    শুধু কি তাই? স্মার্টফোনের নীল আলো সরাসরি চোখে এসে পড়ায় এবং খুব কাছ থেকে অনেকক্ষণ ধরে একটানা ব্যবহার করায় রেটিনার মারাত্মক ক্ষতি হয়। এভাবে স্মার্টফোন দৃষ্টিশক্তি কমিয়ে দিয়ে চোখের ক্ষতি করছে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা ‘ম্যাকুলার ডিজেনারেশান’ নামক রোগের জন্য দায়ি করছেন এই স্মার্টফোনকে। বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘স্মার্টফোনের নীল রঙের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য এসব নানাবিধ ইলেক্ট্রনিক সিগন্যাল আসলে এনার্জি ধ্বংসকারী মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন।’ কে না জানে, মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ মানুষের গোটা দেহ শোষণ করে থাকে।
    স্মার্টফোন শরীরের জলীয় কোষকলা তৈরিতে বাঁধা সৃষ্টি করে। দেহের অভ্যন্তরের এনার্জি ধ্বংস করে। পরমাণু বিস্ফোরণ যেমন বিকিরণ ছড়ায়, এক্স-রে যেমন বিকিরণ ছড়ায়, সূর্যরশ্মি যেমন বিকিরণ ছড়ায়, ঠিক অনুরূপ বিকিরণ স্মার্টফোনেও ছড়ায়। এ বিকিরণে রয়েছে এক্স-রে বা রঞ্জন রশ্মি, এবং জি রে বা গামা রশ্মি। রঞ্জন রশ্মি রক্তের অণুচক্রিকা ভেঙে দেয়। আর গামা রশ্মি সরাসরি আঘাত হানে শরীরের নানাবিধ আনুষঙ্গিক নরম কোষকলায়। এ গামা রশ্মি ডিএনএ (ডি অক্সিরাইবো নিউক্লিয়িক এসিড) কে পরিবর্তন করতে পারে। এমনকি এ বিকিরণ জীবদেহের কোষকলায় দীর্ঘমেয়াদী জ্বলুনি-পুড়ুনি তোলে। পরিণামে ক্যান্সারসহ নানাবিধ বংশগত ত্রুটি-বিচ্যুতি সৃষ্টি হয় এবং তা যুগের পর যুগ চলতে থাকে।
    একথাও সত্য, সব ধরনের ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী যেমন, টিভি থেকে শুরু করে রান্নাঘরের মাইক্রোওয়েভ ওভেন পর্যন্ত বিকিরণ নির্গত করে। তবে যেহেতু, স্মার্টফোন যন্ত্রটা ব্যবহারকারীর দেহের কোমল অঙ্গ- মাথা, ঘাড় ও কানের অতি নিকটে অবস্থান করে। সেহেতু, স্মার্টফোনের বিকিরণ মানবদেহের টিস্যু, ডিএনএ শোষণ করে নিতে বেশি সুবিধা হয়। এ বিকিরণ মানুষের ব্রেইনওয়েভে পরিবর্তন আনতে সক্ষম। এজন্য ব্রিটেনের ন্যাশনাল জিওলজিক্যাল প্রোটেকশন বোর্ড, স্মার্টফোনের বিকিরণ ত্যাগের একটি মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তা হচ্ছে- শূন্য দশমিক এক ওয়াট। এখন বিজ্ঞানীরা স্মার্টফোনের ক্ষতিকর দিক নিয়ে গবেষণায় ব্যাপক জোর দিয়েছেন। স্মার্টফোনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলো গবেষণা কাজে অন্তর্ভুক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এসব গবেষণার বিস্তৃত ফলাফল বেরোতে সঙ্গতকারণেই সময় লাগবে আরও কয়েক বছর।
    বিকিরণ এড়াবেন যেভাবে
    একনাগাড়ে বেশিক্ষণ স্মার্টফোন ব্যবহার না করাই শ্রেয়। হাই রেজুলেশনের ভিডিও গেম খেলার নেশা আরও ক্ষতিকর। শরীর থেকে কিছুটা দূরে স্মার্টফোন রাখা ভালো। পথ চলতে স্মার্টফোন হাতে না নিয়ে ব্যাগে নেওয়া জরুরি। চার্জ দেওয়া অবস্থায় কখনোই স্মার্টফোনে কথা বলা ঠিক নয়। সে সময়ে স্মার্টফোনের চারপাশে একটা ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়। একটানা স্মার্টফোনের দিকে না তাকিয়ে একই সঙ্গে চারপাশে তাকানোর অভ্যাস করুন। রাত জেগে স্মার্টফোন ব্যবহার করবেন না। আর হ্যাঁ। শিশুদের কান্না থামাতে, চুপ করে বসিয়ে রাখতে স্মার্টফোন হাতে তুলে দেবেন না।
    স্মার্টফোনের পরিমিত ব্যবহার আমাদের জীবনযাত্রাকে অনেক সহজ করে দেয়। তেমনই অতিরিক্ত ব্যবহার ক্ষতি করে। অতিরিক্ত সব কিছুই কোনো না কোনোভাবে খারাপ কিছু ডেকে আনে। তখন সে ক্ষতি শুধু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। লক্ষণীয় বাজে প্রভাব শরীর, স্বাস্থ্য ও মনে ছড়িয়ে পড়ে।
    লেখক: গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।