শিক্ষার্থী শূন্য ক্যাম্পাসে শীতের সকাল

0

কুষ্টিয়া সংবাদদাতা॥ শিশিরে ভেজা প্রকৃতি। কুয়াশাচ্ছন্ন ঘাসের ডগায় সূর্যিমামার সোনালি আলোর রাশি। বিস্তৃর্ণ মাঠজুড়ে হলুদ সরষেফুল। পাতাশূন্য গাছ-গাছালি যেন প্রতিটি প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে দাগ কাটে। প্রকৃতির সব রূপ নিয়ে আলপনা আঁকতে আঁকতে নানা বৈচিত্রে শীতের আগমন ঘটে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৫ একরে। কুয়াশা মাখা শীত সকালে কম্বলের তলে সময়ক্ষেপণ। জবুথবু হয়ে ক্যাম্পাসে গমন, ক্যাম্পাস ক্যাফে আর চায়ের টংয়ে গরম গরম চুমুক। ছুটির দিনে প্রেমিকার হাতে বকুল আর শিউলী মালার উপহার, সন্ধ্যা নামলেই জিয়া মোড়ে শীতের পিঠার সমারোহ।
ক্যাম্পাস লেকে অতিথি পাখির কিচিরমিচির, লাল শাপলা, শীতের পোশাক কেনার ব্যস্ততা, সকাল-সন্ধ্যা দিগন্ত বিস্তৃত কুয়াশার মাঝে আগুন জ্বালিয়ে গানের আসর-আড্ডা। দলবেঁধে ক্যাম্পাস পার্শবর্তী গ্রামে খেজুরের রস কিনে খাওয়া-এ সবই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শীত সকালের চিরাচরিত অভ্যাস। কিন্তু করোনা মহামারিতে গত ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও একাডেমিক কার্যক্রম। শিক্ষার্থী শূন্য ক্যাম্পাসে এবারের শীত যেন অন্যরূপেই এসেছে। সেদিন শীত সকালের স্নিগ্ধতা পেতে সূর্যিমামা দেখার আগেই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলাম। জিয়া মোড়ে যেতেই শীতের স্পর্শ! একটু সামনে তাকাতে দেখা গেল ক্রিকেট মাঠটি পুরোটাই কুয়াশার চাদরে মোড়ানো। শিশিরে ভেজা ঘাসগুলোয় পা রাখতেই চমকে উঠলাম। এসময় দূরের ভবনগুলো ঝাপসা-ঝাপসা দেখাচ্ছিল। এরমধ্যে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সকারের ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন। শীতের পোশাকে নারী-পুরুষ দলে দলে হাঁটছেন, কেউ কেউ আবার হাসি-ঠাট্টাতে মেতে উঠেছেন। শিশির ভেজা ঘাসের উপরে একাকী হাঁটতে থাকলাম।
এরই মধ্যে পূর্বাকাশে সূর্যিমামার দেখা। গাছের ফাঁক দিয়ে মৃদু আলো শিশির ভেজা ঘাসের উপর পড়ছে। তখন শিশির ঘাসগুলোর সাথে যেন মুক্তার দানার ন্যায় বেঁধে ছিল। প্রশাসন ভবন সংলগ্ন চত্বরে যেতেই শিউলি ফুলের সৌরভে মুগ্ধ হলাম। এ ফুলের শীতল মিষ্টি গন্ধে সুরভিত হচ্ছে আশেপাশের এলাকা। এসময় সকারের ভ্রমণে বের হওয়া কেউ কেউ ফুল কুড়াতে ব্যস্ত ছিলেন। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদসহ কয়েক জায়গায় দেখা মিলবে এ ফুল গাছের। এছাড়া প্রশাসন ভবন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, প্রকৌশল অফিস, বিশ্ববিদ্যালয় লেক, ডরমিটারি সংলগ্ন পার্ক, উপাচার্যের বাংলো ও আবাসিক হলগুলোতে ফুটে থাকা রঙ্গন, বকুল, গোলাপ, জবা ও পাতাবাহারীর সৌরভে ক্যাম্পাসের ১৭৫ একর যেন সুরভিত। প্রকৌশল অফিস সংলগ্ন সড়কের দুইপাশ দিয়ে ফুটে থাকা হাজারও ফুলের স্নিগ্ধতা যেন ক্লান্ত পথিকের মনকে সতেজতায় ভরে তোলে।
সকালের ভ্রমণে বের হওয়া এক কর্মকর্তা বলেন, হিমেল হাওয়ায় হাড়ে কাঁপন ধরানো এক ঝাঁঝালো মিষ্টি অনুভূতি ছড়াই শীত সকালে ফুটে থাকা এ ফুলগুলো। এ ফুলগুলোই আমার চলাচলের সব ক্লান্তি দূর করে দেয়। আবাসিক হল বন্ধ থাকলেও ক্যাম্পাসের আশেপাশের ম্যাচ ও বাসাবাড়িতে অনেক শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন। যেখানে কিছু শিক্ষার্থী সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত ক্যাম্পাসে হাঁটাহাঁটি করেন। রায়হান বাদশা রিপন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, শীতের সকালে ক্যাম্পাসে হাঁটতে বেশ ভালো লাগে। এসময়টা আমি যেন প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যায়। কিন্তু শিক্ষার্থী শূন্য ক্যাম্পাসে এবারের শীত সকালটা যেন অন্য রকম মনে হচ্ছে। ক্যাম্পাসের ক্লাসরুম, হল, খেলার মাঠ চারদিকে শুধুই পিনপতন নিরবতা। শীতের পুরনো সেই আমেজ যেন হারিয়ে গেছে।
এখানে শীত মানেই সকাল-সন্ধ্যা অতিথি পাখির ঝাঁঝালো কিন্তু মন্ত্রমুগ্ধকর কিচিরমিচির। লেকের দিকে পা দিতেই তাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম। শীত আসার শুরু থেকেই সুদূর সাইবেরিয়া থেকে গুটি গুটি পাখনা মেলে ক্যাম্পাসের লেকে সমাগম ঘটতে থাকে এদের। ক্যাম্পাসের লেকও যেনো শীতের শুরুতেই লাল শাপলা ও কচুরিপানার ফুল ফুটিয়ে তাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকে। এরই মাঝে সূর্যিমামা কিছুটা উপরে উঠে আলোর তীব্রতা বাড়াতে থাকল। দোকানীরা একে একে দোকান খোলা শুরু করেছেন। সকালের ভ্রমণে বের হওয়া ক্লান্ত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে খোশ-গল্পে মেতেছেন।
নির্মাণ শ্রমিকেরা ঘুম থেকে জেগে রুটি-কলায় সকালের নাস্তা সেরে নিচ্ছেন। ভ্যানচালকদেরও আনাগোনা লক্ষ্য করা গেল। কিছুক্ষণ পরে শুরু হলো শ্রমিকদের হাতুড়ির টুং-টাং শব্দ। কুয়াশায় ঢাকা ভবনগুলোতে শ্রমিকদের কাজের ধুম পড়ে গেল। তখন প্রায় সকাল ৯টা বাজে। একে একে সবাই আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করতে শুরু করল। সকাল ১০ টায় অফিস সময়! কিছুক্ষণ পর কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ হতে সারি সারি ক্যাম্পাস বাস আসতে শুরু করল। শুরু হলো করোনাকালে সীমিত আকারের অফিসিয়াল কর্মযজ্ঞ। কুয়াশাঘেরা রূপের মাধুরী নিয়ে শীত আসে এ ১৭৫ একরে। শীত সকালের সবটুকু সৌন্দর্য আর মাধুর্য প্রকৃতি যেন ঢেলে দিয়েছে এখানে। করোনা দুর্যোগ কাটিয়ে ক্যাম্পাসে শীত সকালের চিরাচরিত রূপ খুঁজে পাওয়ার ব্যাকুলতায় এখন সব শিক্ষার্থী। তাদের একটাই কথা, কবে খুলবে ক্যাম্পাস?