মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের একমাত্র সরকারি কুমির প্রজনন কেন্দ্র, কোন বাচ্চা ফুটছে না

0

মনিরুল হায়দার ইকবাল, মোংলা (বাগেরহাট) ॥ মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের একমাত্র সরকারি কুমির প্রজনন কেন্দ্র। পূর্ব সুন্দবনের চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল নামক স্থানে পশুর নদীর পাড়ের নোনা জলের কুমির সংরক্ষণে গড়ে ওঠা দেশের এই প্রজনন কেন্দ্রটিতে গত তিন বছর ধরে কুমিরের কোন বাচ্চা ফুটছে না। গত ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে এ কেন্দ্রের মা কুমির পিলপিল ও জুলিয়েটের ডিম থেকে একটিও বাচ্চা ফোটেনি।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, বিলুপ্তপ্রায় লোনা পানির প্রজাতির কুমিরের প্রজনন বৃদ্ধি ও লালন-পালনের উদ্দেশে ২০০২ সালে করমজল পর্যটন কেন্দ্রে ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে আট একর জায়গায় বনবিভাগের উদ্যোগে দেশের একমাত্র সরকারি কুমির প্রজনন কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়। প্রথমে জেলেদের জালে আটকা পড়া ছোট-বড় পাঁচটি কুমির দিয়ে শুরু হয় কেন্দ্রের প্রজনন কার্যক্রম। এদের মধ্য থেকে প্রজননে সক্ষম দুটি স্ত্রী কুমির ও একটি পুরুষ কুমিরকে বাছাই করা হয়। স্ত্রী কুমির দুটির নাম রাখা হয় জুলিয়েট ও পিলপিল এবং পুরুষ কুমিরটির নাম দেয়া হয় রোমিও। আর এরা ওই নামেই দর্শনার্থীদের কাছে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠে। ২০০৫ সালে প্রথম জুলিয়েট ও পিলপিল ডিম দেয় এবং তাদের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে। এরপর কয়েক দফায় পিলিপিল ও জুলিয়েট ডিম দেয় এবং তা থেকে কম বেশি বাচ্চাও ফোটে।
এক পর্যায়ে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটা কমে যাওয়ায় প্রজনন কেন্দ্রটির ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা শঙ্কা দেখা দেয়। এ অবস্থায় প্রজননে অক্ষম হয়ে ওঠায় ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক থেকে প্রজনন কেন্দ্রের প্যানে আরেকটি নতুন পুরুষ কুমির আনা হয়। এটির নাম দেয়া হয় রোমিও’র পরিবর্তে আলেক জেন্ডার।
এরপর ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও মা কুমির জুলিয়েট ও পিলপিল থেকে কোন বাচ্চা ফোটেনি। চলতি বছরের গত ১২ জুন প্রজনন কেন্দ্রে ৪৪টি ডিম দেয় কুমির পিলপিল। এরপর কুমিরটির নিজ বাসায় ২১টি রেখে বাকিগুলোর মধ্যে ১২টি নতুন ইনকিউবেটর আর ১১টি পুরাতন ইনকিউবেটরে বাচ্চা ফুটানোর জন্য সংরণ করা হয়। নির্দিষ্ট সময় পর কেন্দ্রের নতুন ইনকিউবেটরে রাখা ১১টির মধ্যে চারটি ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হয়। বাকি ডিমগুলো নষ্ট হয়ে যায়।
করমজল বন্যপ্রাণী (কুমির) প্রজনন কেন্দ্রের ইনচার্জ ফরেস্টার আজাদ কবির জানান, গত তিন বছর ধরে এ প্রজনন কেন্দ্রে জুলিয়েট ও পিলপিলের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটছে না। তিনি বলেন, প্রজনন কেন্দ্রের পুরুষ কুমির রোমিও অতিরিক্ত মোটা ও বয়স বেড়ে যাওয়ায় মিটিং পাওয়ার (প্রজনন) সক্ষমতা হারিয়েছে। এ কারণে তাকে প্রজনন প্যান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ওই অবস্থানে দেয়া হয়েছে আরেক পুরুষ কুমিরকে। নতুন এ কুমিরটির নাম রাখা হয়েছে আলেক জেন্ডার। ঢাকার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক থেকে আনা নতুন এ আলেক জেন্ডারকে দিয়ে এবার বাচ্চা ফোটানো হয়।
এদিকে গত ১৭ সালের জানুয়ারিতে কয়েক দফায় ৭১টি কুমির বাচ্চা হারিয়ে যায় এবং বনবিড়ালের আক্রমনে মারা পড়ে। ২০০৯ সালে আইলার জলোচ্ছ্বাসেও ভেসে যায় আরও ৩৮টি কুমির ছানা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় আরও ১৭টি কুমির বাচ্চা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া নদীতে অবমুক্ত করাসহ প্যানের ভেতর রোগাক্রান্ত হয়েও কুমির ছানা মারা যাচ্ছে। সর্বশেষ গত দু’বছর ধরে নতুন করে ডিম থেকে কোন বাচ্চাও ফুটছে না। এ অবস্থায় প্রজনন কেন্দ্রটির ভবিষাৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়।
সূত্র মতে, এই প্রজনন কেন্দ্রটির যাত্রা শুরুতেই কুমির লালন-পালন ও বন্যপ্রাণীর ওপর দুই কর্মকর্তাকে অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী সংরণ কেন্দ্র থেকে বিশেষ প্রশিণের ব্যবস্থা করে বনবিভাগ। এদের মধ্যে আব্দুর রব নামের একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০১৫ সালে ওই বনকর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই কেন্দ্রের কোন কুমির অথবা প্রাণী বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া হয়নি। বনবিভাগের একজন স্টাফ দিয়ে কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে চলছে এই কুমির প্রজনন কেন্দ্রটি। করমজল প্রজনন কেন্দ্রটি বনের পশুপাখির হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হলেও কুমিরসহ বন্য প্রাণীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদিও নেই। এ কারণে করমজল কুমির প্রজনন কেন্দ্রে কুমির বিষয়ে প্রশিক্ষণ ছাড়াই ধারণার ওপর ভরসা রেখে কাজ করছেন বনরক্ষীরা। আর ধারণার ওপর নির্ভর করে এখানে সাপ, হরিণ, বানর, বেজি, গুইসাপসহ আহত ও অসুস্থ সকল প্রাণীর চিকিৎসা দেয়া হয়।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন জানান, এখানে বর্তমানে যে পুরনো ইনকিউবেটর আছে সেগুলো অনেক পুরনো। নতুন যে ইনকিউবেটর তৈরি করা হয়েছে তার ধারণ ক্ষমতা মাত্র ২৪টির। এ ধরনের আরো কয়েকটি নতুন ইনকিউবেটর তৈরি করা গেলে প্রজননে সক্ষমতা আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, কুমিরগুলোর বয়স হয়েছে, এর ফ্যার্টিলিটি কমে গেছে। আমরা পুরাতন মা দুটো কুমির পরিবর্তন করে নতুন দু’টি মা কুমির আনার চেষ্টা চালাচ্ছি।