ভুক্তভোগীরা জেলে দালালদের ধরবে কে?

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ মো. মোমিন মিয়া। কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার এই বাসিন্দা ৪ লাখ টাকা ধারদেনা করে ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন ভিয়েতনামে। এলাকার এক দালাল তাকে মোটা বেতনে কাজের প্রলোভন দেখিয়েছিল সে দেশে। কিন্তু রোজগার দূরের কথা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও হয়নি সেখানে। উল্টো বাড়ি থেকে আরো একলাখ টাকা পাঠিয়ে ছেলের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন হতভাগা এই পিতা। দালালচক্রের মিথ্যা প্রলোভনে ভিয়েতনাম গিয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অবশেষে দূতাবাসের মাধ্যমে দেশে ফিরেছেন মমিন মিয়ার ছেলে সাজ্জাদ হোসেন। কিন্তু তারপরও মুক্তি মেলেনি। হযরত শাহ্‌জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দিয়াবাড়ীতে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন শেষে এখন তার ঠিকানা হয়েছে কারাগারে।
তাকে ছাড়াতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মোমিন মিয়া। এদিকে পাওনাদারদের তাগাদায় বাড়িতেও থাকতে পারছেন না তিনি। ছেলের হাজতবাসের ব্যাপারে তিনি বলেন, এখন মনে হচ্ছে ওই দেশে মরে যাওয়ায় ভালো ছিল। দালালরা ঠিকই ঘুরে বেড়াচ্ছেন অথচ তার ছেলে প্রতারিত হয়েও হাজতবাস করছে। এর শেষ কোথায় তাও জানা নেই। মোমিন মিয়ার ছেলের মতো একই পরিণতি হয়েছে ভিয়েতনাম থেকে ফিরে আসা আরো ৮১ জনের। এছাড়া একইদিন কাতার থেকে ফিরে আসা দুইজনেরও ঠিকানা এখন কারাগার। দেশে ফিরে আসা এসব প্রতারিত কর্মীদের জামিনের জন্য আইনি সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তাবায়ন সংস্থা। গত রোববার এ ব্যাপারে শুনানি হয়েছে। তবে তাদের জামিন নামঞ্জুর করেছেন আদালত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে দালালদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিল, সেখানে প্রতারিত এসব নিরীহ মানুষকে মামলায় জড়ানোটা দুঃখজনক ও বিস্ময়কর।
জানা যায়, দালালচক্রের প্রলোভনে পড়ে বিএমইটি’র ছাড়পত্র নিয়ে প্রায় শতাধিক বাংলাদেশি এ বছরের শুরুতে ভিয়েতনামে যান। কিন্তু তাদের কাজ না দিয়ে আটকে রাখা হয়। কয়েকজনকে কাজ দেয়া হলেও বেতন দেয়া হয়নি। অন্যদিকে বাড়ি থেকে থাকা-খাওয়া বাবদ আরো টাকা পাঠাতে এসব কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে দালালচক্র। কারো কারো পরিবার টাকাও পাঠায়। কিন্তু এভাবে চলতেই থাকলে একসময় তারা দালালদের কব্জা থেকে পালিয়ে সেদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে অবস্থান নেয়। তারা দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে দেশে ফেরত পাঠানোর আর্জি জানায়। কিন্তু তাদের দাবি অগ্রাহ্য করে দূতাবাস। অন্যদিকে, দালালদের বিরুদ্ধেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো দালালদের পক্ষাবলম্বনের অভিযোগ ওঠে দূতাবাস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এই অবস্থায় গতমাসের শুরুর দিকে দীর্ঘদিন অর্ধাহারে-অনাহারে থেকে তারা দূতাবাসের সামনেই অবস্থান নেন। বিষয়টি সে সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। পরে গত ১৮ই আগস্ট তাদেরকে দূতাবাসের মাধ্যমে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতির কারণে সরকারি স্বাস্থ্যনীতিমালা অনুযায়ী ১৪ দিন নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। কিন্তু কোয়ারেন্টিন শেষে তাদের বাড়িতে না পাঠিয়ে মামলা দিয়ে ৮৩ জনকে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেয় তুরাগ থানা পুলিশ। পরে আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়। মামলার এজাহারে ওই ৮৩ জনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় সেদেশে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। এতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন্ন এবং শ্রমবাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ভবিষ্যতে তাদের বাংলাদেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, মামলার এজাহারের সঙ্গে মিল নেই দূতাবাসের বক্তব্যের। গত ১৮ই আগস্ট রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ভিয়েতনামে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা বা সাজার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। দূতাবাসের ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে শুধু বলা হয়েছে, ফেরত আসা এসব কর্মী দেশটিতে অবৈধভাবে অবস্থান করছিলেন। দূতাবাসের অনুরোধে দেশটির সরকার যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। দূতাবাসের ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ‘ভিয়েতনামে আটকে পড়া এসব বাংলাদেশিকে দেশে প্রত্যাবসনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বাংলাদেশ দূতাবাস হ্যানয় বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করে। দূতাবাসের বিশেষ অনুরোধে ভিয়েতনাম সরকার অবৈধ শ্রমিকদের পাসপোর্ট পুনরুদ্ধার, ভিসাহীন অবস্থানের ক্ষতিপূরণ মওকুফ এবং এক্সিট পারমিট প্রদান করে।’ উল্লেখ্য, সেদেশে পৌঁছানোর পর দালালচক্র অনেকের পাসপোর্ট কেড়ে নেয়। কাজের কথা বলা হলেও কারো কারো ভিজিট ভিসা দিয়ে দেশটিতে পাচার করা হয়।
এদিকে অভিবাসী অধিকার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দালালচক্রকে সুবিধা দিতে প্রতারিত এসব বাংলাদেশিকে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। তারা বলছে, যে সকল দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতিনিধি এই পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত তারা বহাল তবিয়তে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, উল্টো পাচারের শিকার হয়ে যারা সর্বস্ব হারিয়েছেন, তারাই এখন জেলে। প্রতারকদের বাইরে রেখে প্রতারিতদের জেলে রাখা মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও শিষ্টাচার বহির্ভূত। ভিকটিমদের আইনি সহায়তা দেয়া প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা মনে করছে, একটি পক্ষকে আড়াল করার জন্য এই সকল ভিকটিমকে জেলে রাখা হয়েছে। সংস্থাটি এ সকল ভিকটিমের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন অব্যাহত রাখতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রতারিত কর্মী সাজ্জাদ হোসেনের পিতা মো. মোমিন মিয়া বলেন, গত জানুয়ারি মাসে তার ছেলে ভিয়েতনাম গেছে। এজন্য স্থানীয় এক দালালকে ৪ লাখ টাকা দিতে হয়েছে, যার পুরোটাই ঋণ করে দিয়েছি। এছাড়া কাজ না থাকায় পরবর্তীতে থাকা-খাওয়া বাবদ দালালদের মাধ্যমে আরো একলাখ টাকা দেয়া হয়েছে। সরকার তাদের দুর্ভোগের কথা জানতে পেরে দেশে আনার ব্যবস্থা করেছে। আক্ষেপ করে মোমিন মিয়া বলেন, এখন মনে হচ্ছে দেশে না এসে ভিয়েতনামে মরে যাওয়ায় ভালো ছিল। তিনি আরো বলেন, একদিকে ছেলের বিরুদ্ধে মামলার কারণে দ্বারে দ্বারে ঘুরছি, অন্যদিকে কিস্তির টাকা দিতে না পারায় পালিয়ে বেড়াচ্ছি। হতভাগা এই পিতা বলেন, কিস্তির ভয়ে সকাল হলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। রাতে বাসায় ফিরি। এভাবে হাঁপিয়ে উঠেছি। অপরদিকে দালালচক্র বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
এসব কর্মীদের পক্ষে আইনি সহায়তা দেয়া প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার নিযুক্ত আইনজীবী এডভোকেট সালমা সুলতানা শিখা তাদের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে বলেন, গত রোববার তাদের জামিনের ব্যাপারে আদালত শুনানি নিয়েছেন। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। পরে বিকালে জানতে পেরেছি আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করেছেন। তিনি আরো বলেন, এরা দালালদের দ্বারা ভিয়েতনামে পাচারের শিকার হয়েছিলেন। আমরা দেখেছি, ঠিকমতো খেতে না পেয়ে শরীর কঙ্কালসার হয়ে গেছে। তারা তো কোনো অপরাধ করেনি বরং প্রতারিত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত ছিল তাদের পাশে দাঁড়ানোর। তা না করে উল্টো ৫৪ ধারায় তাদের জেলহাজতে পাঠিয়েছে। এটা সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন। তিনি আরো বলেন, জামিন পাওয়া যেকোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার। তাছাড়া তারা তো হত্যা মামলার আসামি না। এ ব্যাপারে তিনি সরকারে সুদৃষ্টি কামনা করেন। এদিকে, বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে প্রতারিত কর্মীদের মুক্তির দাবি উঠেছে।