সুজনের আলোচনা : নিজেকে ক্ষমতাহীন করতে চায় ইসি

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিজেরাই নিজেদের ক্ষমতাহীন করতে চায় বলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেছেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনসহ ইসি’র কয়েকটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগের প্রসঙ্গ টেনে তারা বলেন, বর্তমান কমিশনের কার্যক্রমে মনে হচ্ছে তারা সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করবে, কিন্তু নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে না। নির্বাচন কমিশন দেশে সুস্থ নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের আইনে হাত দেয়ার এখতিয়ার নেই। গতকাল অনলাইন গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার। সভা পরিচালনা করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
বক্তারা আরো বলেন, আইন সংস্কারের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করে তারা সরকারের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে চায়। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ভোট আয়োজনে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে তারা এমনটি করে থাকতে পারে। বক্তারা নির্বাচন কমিশন গঠনে সংবিধানের আলোচনায় সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই কমিশনের একটি ভালো দিক রয়েছে। তা হলো একজন কমিশনারকে প্রায়ই নোট অব ডিসেন্ট দিতে দেখি। এর মাধ্যমে আমরা অনেক তথ্য জানতে পারি। তিনি বলেন, পৃথিবীতে তিন টাইপের নির্বাচন কমিশন আছে। ইন্ডিপেনডেন্ট কমিশন, গভর্নমেন্টাল কমিশন এবং মিক্সড কমিশন। মিক্সড কমিশনে সরকারের একটা উইং থাকে, তারা ইসিকে প্রসেস বলে দেয় কমিশন তা বাস্তবায়ন করে। আমাদের সংবিধানে ইন্ডিপেনডেন্ট কমিশনের কথা বলা আছে। কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে আমরা সেই মিক্সড কমিশনের দিকে যাচ্ছি। যেখানে সরকারের উইং ডিকটেড করবে হাউ টু কনডাক্ট পোল। সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, আমি তথ্য পাচ্ছি জাতীয় পরিচয়পত্র প্রজেক্টটি কমিশন সরকারের হাতে তুলে দিতে চাচ্ছে। এনআইডি ভোটার লিস্টের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এটা যদি সরকারকে হস্তান্তর করা হয় তাহলে কমিশনকে ভোটার লিস্টের জন্যও তার (সরকারের) ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে। আর সেই ভোটার লিস্টে প্রকৃত ভোটাররা স্থান পাবে না, পছন্দ মতো ভোটাররা স্থান পাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত কমিশন নিয়োগে আইন করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জ্বি হুজুর কমিশন আসতে থাকবে। তাই আইনটা যাতে হয় তার ওপর জোর দিতে হবে। দরকার হলে এ জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে হবে। আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। সাখাওয়াত হোসেন তার বক্তব্যে প্রান্তিক দলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় এনে তাদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেয়ার সুপারিশ করেন। এই দলগুলো একটি বিধি-বিধানের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে নিবন্ধনের সুযোগ পাবে। এ ছাড়া তিনি দলের ব্যয় মনিটরিং ও নিজেদের উদ্যোগে দলীয় ব্যয়ের অডিট করার ক্ষমতা, নিজেদের এখতিয়ারে ভোট পুনঃগণনার ক্ষমতা, নারী প্রার্থীদের ব্যয় সরকারি তহবিল থেকে নির্বাহ, ইভিএম ব্যবহারের সুপারিশ করেন।
দেশের নির্বাচনগুলোর ফলাফলের প্রসঙ্গ টেনে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার সবগুলোতেই ক্ষমতাসীনরাই জয়ী হয়েছে। বিপরীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে তার কোনোটিতেই ক্ষমতাসীনরা জিততে পারেনি। কাজেই এটা বলা যেতে পারে, ভবিষ্যতেও ক্ষমতাসীনদের অধীনে ভোট হলে তারাই জিতবে। তবে, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনকালে একটি চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের প্রস্তাবনা এসেছিল। কিন্তু একটি দলের অনড় অবস্থানের কারণে সেটা হয়নি। আইন সংশোধন সরকার ও সংসদের বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের স্বপ্রণোদিত হয়ে আইন সংস্কারের উদ্যোগ এখতিয়ার বহির্ভূত। কমিশন আইন সংস্কার করে দেশের ক্ষতি করছে। ভবিষ্যতে আমাদের যে একটা ভালো কমিশন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, সেটা নষ্ট করা হচ্ছে। সাবেক কেবিনেট সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, আইন সংশোধনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কমিশন নিজেদের ক্ষমতাহীন করতে চাচ্ছে। সুস্থ নির্বাচনে বাধ্য করা না গেলে এই ধরনের প্রক্রিয়া চলতে থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই পথ রুদ্ধ করতে হলে রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আমরা সোচ্চার হওয়ার প্রবণতা দেখতে পাই না।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, যে নির্বাচন কমিশন দেশে সুস্থ নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের আইনের হাত দেয়ার এখতিয়ার আছে বলে আমি মনে করি না। তবে, মনে হয় নিজেদের ব্যর্থতাগুলো ঢাকতে নিজেরাই ক্ষমতাহীন হতে চায়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করে কমিশন কেন নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করতে চান সেই প্রশ্ন তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমার মনে হচ্ছে নির্বাচন কমিশন বেতন-ভাতা ও মর্যাদাসহ সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে চায়, কিন্তু নিজেদের দায়িত্বটা পালন করতে চায় না। এ জন্য দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতা থেকে নিজেদের মুক্ত করতেই তারা আইন সংশোধন করতে চাচ্ছে। তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না বলে সরকারের ওপর দায়িত্বটা দিতে চায়। ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছে। তারা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নিজেদের স্থায়ীভাবে পঙ্গু করতে চাচ্ছে। ভবিষ্যতে একটি ভালো কমিশন পাওয়ার পথ রুদ্ধ করছে। বিচারপতি আবদুল মতিন নতুন কমিশন নিয়োগে সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী আইন প্রণয়নের ওপর জোর দেন। এক্ষেত্রে তিনি শামসুল হুদা কমিশন আইনের যে খসড়া করেছিল, তা ধরে নতুন আইন করার কথা বলেন। সুজনের সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনলাইন আলোচনায় আরো অংশ নেন সিনিয়র সাংবাদিক সোহরাব হাসান, সঞ্জীব দ্রং, সুজন নেতা আবু নাসের বখতিয়ার, ফখরুল আলম রেঞ্জু, ইকরাম হোসেন প্রমুখ।