জমি আছে, ঘর নাই’ প্রকল্প যশোর সদর উপজেলায় ঘর নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

0

মাসুদ রানা বাবু ॥ যশোর সদর উপজেলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘জমি আছে, ঘর নাই’ প্রকল্পের কাজে নানা অভিযোগ উঠেছে। ঘর নির্মাণে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে বসবাসের শুরুতে ঘরের স্থায়ীত্ব নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন। আবার যেমন স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আছে ঠিক তেমনি প্রকৃত দাবিদাররা উপেক্ষিত হয়েছেন এমন অভিযোগও আছে।
উপজেলা পরিষদের বরাত দিয়ে জানা যায়, গত ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত এই প্রকল্পে ৩২৫টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে শুধু উপশহর ছাড়া বাকি ইউনিয়নগুলোতে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। ইউনিয়ন প্রতি সর্বনিম্ন ২০টি এবং সর্বোচ্চ ২৮টি ঘর পর্যন্ত বরাদ্দ পায়। একেক ঘর নির্মাণের জন্য এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। বারান্দাসহ সাড়ে ১৬ ফুট বাই সাড়ে ১৫ ফুট আয়তনের ঘরের সাথে আছে একটি স্যানিটারি ল্যাট্রিন। ঘরের ভেতর হবে পাকা এবং ছাউনি ও বেড়া হবে টিনের।
ইতোমধ্যে ঘরগুলোর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। সেখানে উপকারভোগীরা বসবাস করতে শুরু করেছেন। বসবাসের শুরুতে উপকারভোগীদের মাঝে ঘরের স্থায়ীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ঘর নির্মাণে কংক্রিটের যে পিলার ব্যবহার করা হয়েছে তাতে কোন রড দেওয়া হয়নি । ঘর নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে অত্যন্ত নিম্নমানের খোয়াও বালি। সামান্য সিমেন্ট মিশিয়ে পিলারগুলো তৈরি করা হয়েছে। এমনকি তাতে আমা ইটের খোয়াও ব্যবহার করা হয়েছে। যে কারণে ঘর নির্মাণের কিছুদিন যেতে না যেতেই পিলারগুলো খসে পড়ছে। এছাড়া ঘরের ভিতের গাঁথুনিতে যে পরিমাণ ইট ব্যবহারের কথা ছিলো তার চেয়ে সংখ্যায় কম ইট ব্যবহার করা হয়েছে। ঘরের মেঝেতে ইট, বালি, খোয়া ব্যবহার করা হয়নি। অর্থাৎ মেঝেতে দুরমুজ (কমপ্যাক্ট) না করেই পলিথিন বিছিয়ে এক থেকে দেড় ইঞ্চি পরিমাণ ঢালাই দেয়া হয়েছে। মেঝে ঢালাইয়ের ক্ষেত্রে নিম্নমানের ইটের খোয়া ও বালি ব্যবহার করা হয়েছে। যে কারণে বসবাসের শুরুতে মেঝে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। দুরমুজ না করার কারণে স্থানে মেঝে দেবে যাচ্ছে। ঘরের ছাউনি এবং ঘেরার ক্ষেত্রে যে টিন ব্যবহার করা হয়েছে সেটি বাজারের অত্যন্ত নিম্নমানের টিন। একটু ঝড় বৃষ্টি হলেই টিনগুলো দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। ঘরের চালের ফ্রেম তৈরিতেও নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। যে ‘স’ মিলের বাতিল কাঠের সাথে সামান্য কিছু ভালো কাঠ দিয়ে ফ্রেম তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া ঘরের সাথে বরাদ্দকৃত স্যানিটারি ল্যাট্রিনটিও কোনরকম দায়সারাভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এদিকে, ঘর নির্মাণের শ্রমিকদের মজুরি ও খাওয়া বরাদ্দের টাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্তি থাকলেও শ্রমিকদের খাওয়া খরচ দিতে হয়েছে উপকারভোগীদের। সরাসরি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে ঘরগুলো নির্মাণের কথা থাকলেও সেখানে তার প্রতিনিধি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার এটির দেখভালের দায়িত্ব। কিন্তু অধিকাংশ ঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ও চেয়ারম্যান তদারকি করেছেন। আবার বরাদ্দের ক্ষেত্রেও ইউপি চেয়ারম্যানদের সরকারি কোন কর্তৃত্ব না থাকলেও তারা সুপারিশ করে নিজের পছন্দের লোকদের ঘর পাইয়ে দিয়েছেন। যে কারণে প্রকৃত পক্ষে যারা ঘর পাবার দাবি রাখেন তারা উপেক্ষিত হয়েছেন।
সরেজমিন সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে উপকারভোগী ও অন্যান্য বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে ঘর নির্মাণের বিভিন্ন অভিযোগ উঠে আসে। ঘর প্রতি বরাদ্দের অর্ধেক টাকাও ব্যয় হয়েছে কি-না সেটি নিয়েও তারা যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হৈবতপুর ইউনিয়নের তীরেরহাট গ্রামের এক উপকারভোগী বলেন, ‘বসবাসের শুরুর আড়াই মাসের মধ্যে তার ঘরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পিলারগুলো খসে পড়ছে এবং মেঝে ফেটে যাচ্ছে। এই ঘরে আমি পরিবার নিয়ে সামনে কিভাবে বসবাস করবো সেই দুঃশ্চিন্তার মধ্যে আছি।’
ঘর না পাওয়া পাশের মথুরাপুর এক ব্যক্তি বলেন, ‘পৈত্রিক সূত্রের সামান্য জমির ওপর কুঁড়ে ঘরে করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছি। কিন্তু আমি ঘরের জন্য আবেদন করেও পাইনি। আমার সুপারিশ করার মত কেউ নেই। এসব বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ প্রথমেই বলেন, ঘরগুলো ঠিকঠাকভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। বরাদ্দের সময় অনেক সময় ইউপি চেয়ারম্যানরা সুপারিশ করলে তাদের সুপারিশও রাখতে হয়। ঘরে বসবাসের পর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঘর নষ্ট হয়ে গেলে তারা জানালে আমরা পুনরায় মেরামত করে দিই। প্রকৃত দাবিদাররা উপেক্ষিত হচ্ছেন কিনা ? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সবকিছু তো আর সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর হয় না।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রকল্প কমিটির সভাপতি মো. কামরুজ্জামান বলেন, ঘর নির্মাণের সময় আমি এখানে ছিলাম না। আমি নতুন যোগদান করেছি। এ বিষয়ে আমার জানা নেই। যদি কোন উপকারভোগী ঘরের বিষয় অভিযোগ দেন তাহলে সেটি মেরামত করে দেয়া হবে।