শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সামাজিক সব বাধা অতিক্রম করে দেশের প্রায় প্রতিটি খাতে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও এসব খাতে পুরুষের তুলনায় নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীদের এ অনগ্রসরতা আরো দৃশ্যমান। এ অবস্থায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবেলার জন্য প্রযুক্তিতে তরুণ ও নারীদের অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এমনটি জানান আলোচকরা।
‘জেন্ডার অ্যান্ড ইয়ুথ ইনক্লুসিভনেস ইন টেকনোলজি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবিরের সভাপতিত্বে ওয়েবিনারটি পরিচালনা করেন সানেমের গবেষণা পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা। বিশেষজ্ঞ আলোচক হিসেবে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এটুআই প্রোগামের নীতিবিষয়ক উপদেষ্টা আনির চৌধুরী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (কারিগরি) আয়াতুল ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (যুব) মোহাম্মদ সায়েদ আলী এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফারহানা রহমান।
ওয়েবিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সানেমের রিসার্চ ইকোনমিস্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক মাহতাব উদ্দিন। সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান ওয়েবিনারে বিশেষ বক্তব্য রাখেন।
জনমিতির লভ্যাংশের সুবিধা অর্জনের জন্য তরুণ জনগোষ্ঠীর গুণগত মান উন্নয়ন ও তাদের উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে সূচনা বক্তব্যে ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ডিজিটাল বিভাজনের মধ্যে বিশেষ কিছু বিভাজন রয়েছে, যেমন লিঙ্গ বিভাজন, বয়সগত বিভাজন এবং অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন। এ বিভাজন দেখা যায় উচ্চশিক্ষায়, প্রশিক্ষণে, উদ্যোগে, অভিবাসনে, গবেষণায় এবং বিশেষ করে প্রযুক্তি ব্যবহারে।
ড. সেলিম রায়হান তার আলোচনায় বলেন, চলমান কভিড-১৯ সংকটে এ ডিজিটাল অসমতার বিষয়টি আরো প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের বাধাগুলো তুলে ধরেন। প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তিতে খরচই একমাত্র অন্তরায় নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সানেমের রিসার্চ ইকোনমিস্ট মাহতাব উদ্দিন ওয়েবিনারে গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলো উপস্থাপন করেন। সেখানে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার সঠিকভাবেই ডিজিটাল বাংলাদেশের নীতি গ্রহণ করেছে। তবে জেন্ডার, বয়স, অঞ্চল এবং আয় ক্ষমতাভেদে প্রযুক্তির সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে এখনো বৈষম্য বিরাজ করছে।
গবেষণালব্ধ ফলাফল উল্লেখ করে তিনি বলেন, তরুণদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ছেলের মোবাইল ফোন থাকলেও মেয়েদের মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশের মোবাইল ফোন আছে। আর সবচেয়ে বেশি আয় করে যে ১০ শতাংশ পরিবার, সেখানে ৯২ শতাংশ তরুণের মোবাইল ফোন আছে। অন্যদিকে সবচেয়ে কম আয় করে যে ১০ শতাংশ, সেখানে ৭২ শতাংশ তরুণের মোবাইল ফোন আছে। সবচেয়ে বেশি আয় করা ১০ শতাংশ পরিবারের ৭৩ শতাংশ তরুণীর হাতে মোবাইল ফোন থাকলেও সবচেয়ে কম আয় করা ১০ শতাংশ পরিবারের মাত্র ২৪ শতাংশ তরুণীর নিজস্ব মোবাইল ফোন রয়েছে। ফলে স্পষ্টতই, নিম্নতম আয়ের দশমাংশে এক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে মোবাইল মালিকানার পার্থক্য ৪৪ আর উচ্চতম আয়ের দশমাংশে এ পার্থক্য ১৯।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, দরিদ্র এবং দরিদ্র নয় উভয় ক্ষেত্রেই মোবাইল মালিকানার হার নারীর চেয়ে পুরুষের বেশি। দরিদ্র পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে সব বয়স শ্রেণীতেই নারীর মোবাইল মালিকানা প্রায় একই রকম (৩৪ থেকে ৩৭ শতাংশ)। অন্যদিকে অর্থনৈতিক অবস্থা যা-ই হোক না কেন, গড়ে পুরুষদের থেকে নারীদের মোবাইল ফোন অনেক কম।
কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও ডিজিটাল বৈষম্য আছে উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলাদেশে মাত্র ৬ শতাংশ পরিবারের কম্পিউটার আছে। ৪ শতাংশেরও কম নারী কম্পিউটার ব্যবহার করেছে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্যও বিদ্যমান। ঢাকা ও চট্টগ্রামে অন্য বিভাগের চেয়ে কম্পিউটার মালিকানা অনেক বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। শহর অঞ্চলে মাত্র ৫০ শতাংশ পরিবারের ইন্টারনেট সুবিধা আছে। গ্রামাঞ্চলে এ সুবিধা আছে মাত্র ৩০ শতাংশ পরিবারের। সারা দেশে মাত্র ১০ শতাংশ নারী ইন্টারনেট
ব্যবহার করে। অন্যদিকে মোবাইল ইন্টারনেট সেবার দ্রুততার ক্ষেত্রে র্যাংকিয়ে ১৪৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৪। ফলে শুধু ইন্টারনেট সেবাপ্রাপ্তিই নয়, সেবার মানও প্রশ্নসাপেক্ষ।
মাহতাব উদ্দিন গবেষণার ভিত্তিতে কিছু প্রস্তাবও তুলে ধরেন। তিনি জেন্ডার অন্তর্ভুক্তিমূলক আইসিটি নীতি, জেন্ডার অন্তর্ভুক্তিমূলক আইসিটি কর্মপরিকল্পনা এবং আইসিটিবান্ধব আর্থিক নীতি প্রণয়নের প্রস্তাব তুলে ধরেন। এছাড়া টেলিকমিউনিকেশন খাতের জন্য করছাড়ের কথাও বিবেচনা করা যেতে পারে বলে মত দেন তিনি।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী প্রযুক্তি বিভাজনের মূল কারণ হিসেবে সামাজিক প্রেক্ষাপটে মেয়েদের বিভিন্ন বাধাকে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, সামাজিক নানা সংস্কার এবং রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে প্রায়ই নারীদের প্রযুক্তি ব্যবহারে বাধা দেয়া হয় বা নিরুৎসাহিত করা হয়। অনলাইনে নারীদের নানা হয়রানিরও শিকার হতে হয়। উপযুক্ত অবকাঠামো থাকলেও যদি নারীদের জন্য এ বাধাগুলো দূর না করা যায়, তবে প্রযুক্তিতে নারীদের সম্পূর্ণ অন্তর্ভুক্তি সম্ভব হবে না।
কভিড-১৯ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে আনির চৌধুরী বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ নতুন চাকরি তৈরি হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কল্যাণে, যার মধ্যে বেশির ভাগই অনানুষ্ঠানিক খাতে। এ বিপুল কর্মসংস্থানের জন্য তরুণ প্রজন্মকে উপযোগী করে তুলতে দক্ষতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
আয়াতুল ইসলাম বলেন, দক্ষতা উন্নয়ন সংক্রান্ত অনেক উদ্যোগই সরকার নিয়েছে। ২০২২ থেকে সব স্কুল/মাদ্রাসায় কারিগরি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার কাজ চলছে। মূলধারায় নারীদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্যও উপবৃত্তিসহ বিভিন্ন দিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
মো. সৈয়দ আলি বলেন, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার তুলনায় কারিগরি প্রশিক্ষণে তরুণদের মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনটি বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। সেদিকে দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন।
ফারহানা রহমান তার আলোচনায় বলেন, কর্মক্ষেত্রে, উদ্যোক্তা তৈরিতে এবং প্রযুক্তিতে অসমতা দূরীকরণে সামাজিক মানসিকতা পরিবর্তনের বিষয়টি নীতির আওতাভুক্ত করা দরকার। এজন্য সার্টিফিকেটনির্ভর উচ্চ শিক্ষায় উৎসাহী না হয়ে যেন তরুণরা দক্ষতানির্ভর কর্মসংস্থানে নির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করে সে ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে ফারাহ কবির বলেন, প্রযুক্তির বিভাজনের প্রথম বাধাটি আসে নারীর পরিবার ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি থেকে। এজন্য গণমাধ্যমে ইতিবাচক সাফল্যের গল্পগুলো তুলে ধরার মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা যেতে পারে। এ সময় বেসরকারি খাতকে তিনি একটি অ্যাপ নির্মাণ করার ধারণা দেন।