করোনার থাবায় যশোরে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস

0

শেখ আব্দুল্লাহ হুসাইন ॥ করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বিস্তারে সারা দেশের মত যশোরেও ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে। সংক্রমণে শুধু রোগীরাই নয়, এর থাবায় যেন দেশের আপামর জনতা আক্রান্ত হয়েছেন। গত মার্চে বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত শনাক্তের পর বন্ধ করে দেয়া হয় অফিস-আদালত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শপিংমল ও দোকান খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হলেও কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে এখনও খোলার অনুমতি মেলেনি। বর্তমান সময়ে সকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দোকান খোলার অনুমতি থাকলেও করোনা সংক্রমণের ভয়ে অনেক মানুষ ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। একান্ত প্রয়োজনে সীমিত আকারে ক্রেতাদের বাজারে আগমন ঘটলেও তাতে বেচাকেনায় কোনো সুফল আসছে না। এমনটাই জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে হলেও কমিউনিটি সেন্টারগুলো খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।


গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমিত রোগী শনাক্তের ঘোষণা দেয় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। গত ১৯ মার্চ দেশে প্রথম সত্তরোর্ধ্ব এক ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্বাস্খ্য অধিদফতরের সূত্রমতে গতকাল ২০ আগস্ট পর্যন্ত দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৫ হাজার ৯১। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৩ হাজার ৭৮১ জন আর সুস্থ হয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার ৭৩৮ জন। আর যশোর জেলায় গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্য দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬০৫। এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৩৪ জনের। এখনও করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় যশোরে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমে এসেছে। শহরে মণিহার কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপক মোল্লা ফারুক আহমেদ জানান, সরকারের নির্দেশমত গত ২৫ মার্চ থেকে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার অনুমতি মিললেও কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে এখনও কোনো নির্দেশনা আসেনি। এর সাথে সংযুক্ত যেমন ডেকোরেটর ও লাইটিং ব্যবসায়ও স্থবির হয়ে আছে। লাইটিং ব্যবসায়ী শহরের বিকে রোড (বস্তাপট্টি) বেজপাড়ার জিতু ইলেক্ট্রিক ডেকোরেশনের স্বত্বাধিকারী গোলক চন্দ্র দত্ত জানান, তারা এবং কমিউনিটি সেন্টার ব্যবসায়ীরা তাদের কার্যক্রম চালুর অনুমতি চেয়ে যশোর জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। কিন্তু জেলা প্রশাসন এখনও তাদেরকে অনুমতি দেয়নি। শহরের খুলনা রোড বকচরের আয়েশা ডেকোরেটরের স্বত্বাধিকারী কওসার খান জানান, ‘গত পাঁচ মাস ব্যবসা গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। কোনো কাজ নেই ।’ এ সময় সংসারের চাহিদা মেটাতে তিনি দিনমজুরের কাজও করেছেন বলে জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল বৃহস্পতিবার যশোর জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান লোকসমাজকে বলেন, ‘ওদের সংগঠনগুলো আমার কাছে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত কমিউিনিটি সেন্টারগুলো খুলে দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এখনও খুলে দেয়ার আদেশ দেয়া হয়নি, তবে আমরা একটু অপেক্ষা করছি।’ শহরের কাপুড়িয়াপট্টি ও চুড়িপট্টি এলাকার সোনার দোকানগুলো খুলেছে। বেচাকেনাও টুকটাক হচ্ছে। তবে রোজার ঈদে সোনার দোকানগুলো পুরোপুরি বন্ধ থাকায় ব্যবসায় মন্দা গেছে বলে জানিয়েছেন সোনা ব্যবসায়ীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির যশোর জেলা শাখার সভাপতি রকিবুল ইসলাম চৌধুরী সঞ্জয় লোকসমাজকে জানান, ‘একদিকে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি, তার ওপর সোনার দাম বাড়াতে ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। রোজার সময় স্বাভাবিকভাবে সোনা বেচাকেনা বাড়ে, কিন্তু এ সময়টায় দোকানগুলো বন্ধ ছিল। যে কারণে ব্যবসায় মন্দাভাব গেছে। তবে কুরবানি ঈদের পর থেকে টুকটাক বেচাকেনা হচ্ছে।’ তিনি আশা করেন করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে সোনার ব্যবসা স্বাভাবিক হয়ে আসবে। শহরের এইচ এম এম রোডের এইচ এম কথ স্টোরের স্বত্বাধিকারী ও ছিট কাপড় ব্যবসায়ী মালিক সমিতিরি সভাপতি আবু হোসেন জানান, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে তারা প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখন সকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দোকান খোলার অনুমতি মিললেও করোনা সংক্রমণের ভয়ে সচেতন মানুষ ঘরের বাইরে হচ্ছেন না। তিনি আরও জানান, তাদের বেচাকেনা শতকরা ২০ ভাগের নিচে নেমে এসেছে। করোনাকালে গত পাঁচ মাসে এসব দোকানের অনেক কর্মচারীই মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। বেঁচে থাকার তাগিদে কেউ কামলা খেটেছেন আবার কেউবা ইজিবাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন বলে আবু হোসেন জানান। এদিকে. শহরের মুজিব সড়কের তৈরি পোশাক রঙ ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী তনুজা রহমান মায়া জানান, ‘করোনা পরিস্থিতিতে এ বছর তাদের বিক্রি শতকরা ১০ ভাগের নিচে নেমে এসেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যবসার অবনতি হয়েছে ১লা বৈশাখ থেকে। ১লা বৈশাখ এবং দুই ঈদ আমাদের ব্যবসা হয়নি। বৈশাখে যখন ব্যবসা হয়নি, আমরা আশা করেছিলাম ঈদ করতে পারবো, কিন্তু আমরা সেটাও করতে পারলাম না।’ অন্যদিকে, অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি আবাসন ব্যবসায়ও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার যশোর শহরের অন্যতম আবাসন ব্যবসায়ী সান ফাওয়ার বিল্ডার্স অ্যান্ড প্রোপার্টিজ লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম জানান, ‘গত মার্চ মাস থেকে তাদের ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। মানুষ এখন বেঁচে থাকার তাগিদে টাকা-পয়সা অন্য খাতে খুব একটা খরচ করছেন না। ইতোমধ্যে যারা বুকিং দিয়েছেন তারা যেমন টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না, তেমনি নতুন কোনো ফ্যাটও করোনাকালে বিক্রি হচ্ছে না। তবে কাজ না থাকলেও তিনি তাদের স্টাফদের বেতন দিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান।