করোনা নিয়ে আতঙ্ক নেই যেখানে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ‘নয় ভাই’ বস্তি। রাজধানীর অর্ধশত বছরের পুরনো বস্তি এটি। হাজারীবাগের সনাতনগড় বৌ-বাজার এলাকায় এর অবস্থান। প্রায় পাঁচ শতাধিক লোকের বাস এখানে। ছোট ছোট প্রায় ৫০টি টিনশেড ঘর রয়েছে। ঘরগুলোতে ঠাসাঠাসি করে বাস করেন বাসিন্দারা। পুরোটাই ঘনবসতি। করোনাকালে যেখানে বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জোর আওয়াজ তুলেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার।
সেখানে বস্তিটিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোনো বালাই চোখে পড়েনি। ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া তো দূরের কথা, কেউ মাস্কও পরছেন না। নেই কোনো সামাজিক দূরত্ব মানার চিহ্নও। কাঁধে কাঁধে হাতে হাত ধরে চলাফেরা করছে বস্তির শিশুরা। বয়স্ক কয়েকজন বাসিন্দা জানান, দেশে করোনা শনাক্তের প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসে তাদের বস্তিতে কারো কোনো জ্বর, সর্দি, কাশিও হয়নি। কাউকে হাসপাতালেও যেতে হয়নি। এই বস্তির এক বাসিন্দা পারুল বেগম। বয়স ৫০ বছর। ছয় সদস্যের পরিবার তার। বস্তিতে আড়াই হাজার টাকা ভাড়ায় থাকেন ছোট্ট একটি ঘরে। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমরা রোদ-বৃষ্টিতে থাকি। এসি নাই। গরম পাই, খোলা বাতাস খাই। করোনায় আমাদের কিছুই হবে না। আল্লাহই আমাদের রক্ষা করবেন। কোনো মাস্ক পরেন না তিনি এবং তার পরিবারের কোনো সদস্যও। তবে করোনা ছোঁয়াচে রোগ, এটা তিনি জানেন। করোনাকালে কেউ স্বাস্থ্য সচেতনতার বার্তা নিয়ে এই বস্তিতে আসেননি বলেও জনান পারুল বেগম। যেটুকু জানেন তাও টেলিভিশন দেখে। ৫৫ বছর বয়সী আরেক বাসিন্দা সেলিনা বেগম। বস্তিতে তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে আছেন। গত পাঁচ মাসে তার কোনো জ্বর, সর্দি, কাশিও হয়নি। সুস্থ আছেন। তিনি জানান, বস্তিতে এই সময়ে কারো জ্বর হয়েছে বলেও শোনেননি। অসুখ নেই। কেনো পরীক্ষা করাবেন বলে প্রশ্ন করেন তিনি। মাস্কও পরেন না এই বস্তিবাসী। গরিব মানুষ। টাকা নেই, খেতেই পারছি না। ঘন ঘন হাত ধোয়ার জন্য সাবান পাবো কোথায়? করোনাকালে কেউ এই বস্তিতে সাহায্য দিতে আসেননি বলেও অভিযোগ করেন সেলিনা বেগম। বললেন, শুধু ছাত্ররা কিছু মাস্ক দিয়েছে চার মাস আগে। আর কিছুই পাইনি। বস্তির অপর বাসিন্দা ৩৫ বছর বয়সী রেখাও প্রায় একই কথা বললেন।
বস্তিবাসীদের মধ্যে করোনা কম কেন-জানতে চাইলে জনস্বাস্ব্য বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, গরিব মানুষরা সামান্য সর্দিকাশি হলে হাসপাতালে যেতে চান না। কারণ তারা কাজ না করলে সংসার চলে না। পেটে ভাত জোটে না। যদি একজন ড্রাইভার বলেন তার সর্দি জ্বর হয়েছে তাহলে কেউ তাকে নেবেন না। একজন কাজের বুয়া যদি বলে তার জ্বর। তাহলে তিনি কাজ পাবেন না। এজন্য তারা সংক্রমণকে লুকান। বস্তিতে ভালো করে জরিপ করলে সত্যিকারের চিত্র পাওয়া যাবে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। বস্তিতে করোনার সংক্রমণ কম জরিপের এমন ফলাফল সম্পর্কে জানতে চাইলে- রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর পরিচালক এবং সদ্য নিয়োগ পাওয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, এটা নিয়ে বিস্তারিত জানানো হবে। তবে তিনি মনে করেন বস্তিবাসীরা একটু খোলামেলা জায়গায় থাকেন। করোনা একটি বদ্ধ দেয়ালের মধ্যে থাকলে সংক্রমণ হয়। তিনি বলেন, শুরুতে লকডাউনের সময় তারা বিভিন্ন বহুতল বাসাবাড়িতে ঢুকতে পারেননি এবং অনেকের সংস্পর্শে আসেননি। এর ফলে সংক্রমণ কম হয়েছে বলেও তিনি মনে করেন। নির্দিষ্ট কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ এখনো বলতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক সেব্রিনা ফ্লোরা।
সম্প্রতি করোনা নিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা সংস্থা (আইসিডিডিআর,বি’) যৌথভাবে এক জরিপ করেছে। জরিপে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। সার্বিকভাবে এ হার ৯ শতাংশ হলেও বস্তিতে এ হার ৬ শতাংশ। জরিপে রাজধানীর ৬টি বস্তি এলাকাসহ বিভিন্ন বাড়ি পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনকালে যেকোনো একটি বাড়ির চারজনের মধ্যে একজনের শরীরে পরিদর্শনের দিন কিংবা পরবর্তীতে ৭ দিনের মধ্যে করোনার চারটি উপসর্গের একটি পাওয়া গেলে তাকে উপসর্গের রোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একইভাবে রাজধানীর ছয়টি বস্তি এলাকাসহ বিভিন্ন বাড়ি পরিদর্শনকালে যেকোনো একটি বাড়ির চারজনের মধ্যে একজনের পরিদর্শনের দিন কিংবা পরবর্তীতে ৭ দিনের মধ্যে করোনার চারটি উপসর্গের একটিও না পাওয়া গেলে তাকে উপসর্গবিহীন রোগী ধরা হয়। মোট ৩ হাজার ২২৭টি বাড়ি পরিদর্শনকালে ২১১ জন করোনা উপসর্গের রোগী পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে ১৯৯ জনের নমুনা আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। উপসর্গ রয়েছে এমন বাড়ি থেকে উপসর্গবিহীন ৪৩৫ জনের মধ্যে ২০১ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। উপসর্গবিহীন বাড়ি থেকে ৮২৭ জনের মধ্যে থেকে ৫৩৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়া রাজধানীর ছয়টি বস্তি এলাকার ৭২০ বাড়ি থেকে পৃথক নমুনা সংগ্রহ করা হয়। জরিপে দেখা গেছে, যেসব বাড়িঘর পরিদর্শন করা হয়েছে তাদের মধ্যে ৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে করোনার উপসর্গ পাওয়া গেছে। মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশের মধ্যে উপসর্গ পাওয়া যায়। যতো সংখ্যক বাড়ি পরিদর্শন করা হয়েছে তার ভিত্তিতে শতকরা ৯ শতাংশ করোনা পজেটিভ রোগী পাওয়া যায়। মোট করোনা পজেটিভ রোগীর মধ্যে ১৩ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের বেশি, ১৫ থেকে ১৯ বছরের ১২ শতাংশ এবং ১০ বছরের কম বয়সী করোনা রোগী ৬ শতাংশ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০১৪ সালে বস্তি শুমারি করেছিল পরিসংখ্যান ব্যুরো। প্রতিবছর নদী ভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা শুধু কাজের খোঁজেই হাজার হাজার মানুষ ঢাকা আসছেন। তথ্য মতে, ঢাকা শহরের দুই সিটি করপোরেশনে মোট ৩ হাজার ৩৯৪টি বস্তি রয়েছে। সেখানে মোট ঘরের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজারের মতো। এতে সাড়ে ৬ লাখের মতো লোক এসব বস্তিতে বসবাস করেন। পাঁচ বছর পর সেটা কতো হয়েছে তা নিশ্চিত নয়। অর্ধেকের বেশি বস্তি সরকারি জমিতে তৈরি। ৬৫ শতাংশ বস্তিবাসী ভাড়া থাকেন।