১ মাস বাড়ল বৈশ্বিক উত্তোলন হ্রাস চুক্তির মেয়াদ

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজার ভারসাম্য ফেরাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ বা ওপেক। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত এপ্রিলে মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে পণ্যটির সর্বোচ্চ উত্তোলন হ্রাসসংক্রান্ত একটি চুক্তি সই করে জোটটি। লক্ষ্য ছিল বাজারে জ্বালানি পণ্যটির উদ্বৃত্ত সরবরাহ রোধ করে দামে চাঙ্গা ভাব ফেরানো। এরই মধ্যে পরিকল্পনাটির সুফল পেতে শুরু করেছে ওপেক প্লাস জোট। গত দুই মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এ ধারাবাহিকতায় ওপেক, রাশিয়া ও এর মিত্র দেশগুলো সম্প্রতি চলমান চুক্তির মেয়াদ আরো এক মাস বাড়িয়ে জুলাইয়ের শেষ নাগাদ পর্যন্ত করার বিষয়ে একমত হয়েছে। খবর রয়টার্স ও ফিন্যান্সিয়াল টাইমস।
জ্বালানি তেলের বাজার নিয়ে কর্তব্য নির্ধারণে সম্প্রতি বৈঠকে বসে ওপেক প্লাস। এ সময় চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর সঙ্গে যেসব দেশ মে ও জুনে নির্ধারিত কোটার অতিরিক্ত জ্বালানি তেল উত্তোলনে করেছে, তাদের আগামী জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়তি উত্তোলন কমিয়ে নির্দিষ্ট কোটায় ভারসাম্য ফেরানোর দাবি জানিয়েছে জোটটি। ওপেকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কোটার তুলনায় মে মাসে ইরাক দৈনিক গড়ে ৫ লাখ ২০ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বেশি উত্তোলন করেছে। এছাড়া নাইজেরিয়া দৈনিক গড়ে ১ লাখ ২০ হাজার ব্যারেল, অ্যাঙ্গোলা ১ লাখ ৩০ হাজার, কাজাখস্তান ১ লাখ ৮০ হাজার ও রাশিয়া দৈনিক গড়ে এক লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল বেশি উত্তোলন করেছে।
এদিকে ওপেক প্লাসের চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধিতে যোগ দেবে না বলে জানিয়েছেন মোক্সিকোর জ্বালানিমন্ত্রী রসিও নাহলে। এর আগে চুক্তিটি কার্যকরের প্রথম দিকে আপত্তি দেখালেও পরে মেনে নিয়েছিল দেশটি। চুক্তির আওতায় মে ও জুনে কোটা মেনে সক্ষমতার তুলনায় দৈনিক গড়ে ১০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল উত্তোলন কমিয়েছে দেশটি।
২০১৭ সাল থেকে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার টানা দরপতনের মুখে রয়েছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে এসে চরম আকার ধারণ করে। এর মূল কারণ নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। চীনের উহান ছাড়িয়ে বৈশ্বিক মাহামরীতে পরিণত হওয়া প্রাণঘাতী ভাইরাসটির প্রকোপে চলতি বছরের প্রথম দিকে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা দৈনিক গড়ে তিন কোটি ব্যারেলের বেশি কমে যায়, যা পণ্যটির মোট বৈশ্বিক চাহিদার ৩০ শতাংশ।
এতে আগে থেকে ধুঁকতে থাকা জ্বালানি তেলের বাজার বড় ধরনের ধাক্কা খায়। বৈশ্বিক চাহিদার এমন অপ্রত্যাশিত পতনে লাগামহীনভাবে কমতে শুরু করে পণ্যটির দাম। কমতে কমতে এপ্রিলের শেষ নাগাদ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম শূন্য ডলারের নিচে নেমে যায়। তবে শুধু বৈশ্বিক চাহিদার পতন নয়, মার্চের শুরুর দিকে ওপেক প্লাসের ব্যর্থ বৈঠক পণ্যটির রেকর্ড মূল্য হ্রাসে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। রাশিয়ার আপত্তিতে চুক্তি ছাড়া ভেস্তে যায় ওই বৈঠক। এর জের ধরে সৌদি আরব ও রাশিয়া পণ্যটির মূল্যযুদ্ধে জাড়িয়ে পড়ে। একদিকে করোনার প্রভাবে বৈশ্বিক চাহিদায় ধস, অন্যদিকে চলমান মূল্যযুদ্ধ—সব মিলিয়ে গত ২০ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এক ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল মাইনাস ৩৭ দশমিক ৬৩ ডলারে বিক্রি হয়েছিল।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজারের যখন এ হাল, তখন পণ্যটির দামে চাঙ্গা ভাব ফেরাতে করণীয় নির্ধারণে বসে ওপেক প্লাস। বৈঠকে ওপেকভুক্ত দেশ, রাশিয়া ও অন্য সহযোগী দেশগুলো মে ও জুনজুড়ে জ্বালানি পণ্যটির উত্তোলন সক্ষমতার তুলনায় দৈনিক গড়ে ৯৭ লাখ ব্যারেল কমিয়ে আনার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে, যা পণ্যটির মোট বৈশ্বিক সরবরাহের ১০ শতাংশ। চুক্তির নথি অনুযায়ী, জোটের সব সদস্য দেশ মোট সক্ষমতার ২৩ শতাংশ জ্বালানি তেল উত্তোলন কমাবে। এর মধ্যে সৌদি আরব ও রাশিয়া প্রত্যেকেই আলাদাভাবে পণ্যটির উত্তোলন দৈনিক গড়ে ২৫ লাখ ব্যারেল এবং ইরাক একা দৈনিক গড়ে ১০ লাখ ব্যারেল কমাবে। ওপেকের ইতিহাসে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এটাই সর্বোচ্চ জ্বালানি তেলের উত্তোলন হ্রাস চুক্তি।
এছাড়া ওই বৈঠকে আরো পরিকল্পনা করা হয়, দুই মাস মেয়াদি চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চলতি মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ৭৭ লাখ ব্যারেল করে জ্বালানি তেল উত্তোলন কমিয়ে আনতে পারে সদস্য দেশগুলো। এর সঙ্গে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত জোটটি পণ্যটির উত্তোলন দৈনিক গড়ে ৬০ লাখ ব্যারেল কমিয়ে আনতে পারে বলে জানায়। তবে সর্বশেষ বৈঠকে জোটটি চলমান চুক্তির মেয়াদ আরো এক মাস বাড়ানোর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে।
ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সৌদি আরবের জ্বালানিমন্ত্রী আব্দুল্লাহ বিন সালমান বলেন, নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় জ্বালানি তেলর শীর্ষ ভোক্তা দেশগুলো লকডাউন থেকে সরে এসেছে। এতে এসব দেশের অর্থনৈতিক গতি পুনরায় দ্রুততর হয়ে উঠছে। বাড়ছে জ্বালানি তেলের চাহিদা। ফলে মহামারীর ফলে ধসে যাওয়া চাহিদায় চাঙ্গা ভাব ফিরছে। এদিকে ওপেক প্লাস জোটের রেকর্ড উত্তোলন হ্রাসের মাধ্যমে বাজারে পণ্যটির উদ্বৃত্ত সরবরাহ বেশ কমে এসেছে। এ পরিস্থিতি পণ্যটির মূল্যবৃদ্ধিতে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। তবে পণ্যটির বাজারের অনিশ্চয়তা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। সামনে তাদের আরো অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে ওপেকের জ্বালানি তেলের উত্তোলন হ্রাস চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্তে পণ্যটির বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সর্বশেষ কার্যদিবসে আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ প্রতি ব্যারেল বেন্ট্রের দাম বেড়ে ৪২ ডলার ৭১ সেন্টে উন্নীত হয়েছে, আগের দিনের তুলনায় যা ৪১ সেন্ট বা দশমিক ৯৭ শতাংশ বেশি। একই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম আগের দিনের তুলনায় ৩১ সেন্ট বা দশমিক ৭৮ শতাংশ বেড়ে ৩৯ ডলার ৪৬ সেন্টে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া শীর্ষ ভোক্তা দেশ চীনের রেকর্ড আমদানি মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।
নরওয়েভিত্তিক জ্বালানি বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান রাইস্টাড এনার্জির বিশ্লেষক বজর্নার টোনহোগেন বলেন, গতকাল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের প্রতি ব্যারেল ৪০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে, আগামীতে পণ্যটির বাজার শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।