উপমহাদেশে করোনা মোকাবেলা

0
আমিরুল আলম খান
প্রায় চার মাস ধরে দুনিয়া জুড়ে চলছে করোনার (কোভিড-১৯) তা-ব। প্রথমে চীনে, তারপর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, হঠাৎ করে ইরান, মধ্যপ্রাচ্য। কিন্তু ইতালিতে যখন করোনার তা-ব শুরু হলো, তখন দুনিয়া হতবাক হলো অনেক বেশি। প্রায় একই সাথে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। ইউরোপ উন্নত। আধুনিক তাদের জীবন ব্যবস্থা। সারা দুনিয়া তো তাদেও গুরু মানে। কিন্তু চীনে শুরু হয়ে কোভিড-১৯ যে ইউরোপে এমন ভয়ংকর রূপ নেবে তা বোধ হয় দুনিয়ার কেউ স্বপ্নেও ভাবে নি।
তবে চীনে যখন শুরু হলো, পশ্চিমা দুনিয়া তাদের ধুয়ে দিতে লাগল। ওদিকে দুনিয়ার মাতবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার দেশে করোনা হানা দেবার আশংকাকে ‘হোক্স’ বলে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন। এমন কি গোয়েন্দা রিপোর্ট বা স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের তিনি যা-তা বলে গাল পাড়লেন। তিনি আবার হাল আমলে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’র সবচেয়ে বড় ফেরিওয়ালা। অর্থবিত্ত, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শাসন-ত্রাসণে তাদের জুড়ি নেই গত এক শ’ বছরে। তামাম দুনিয়া বোমা মেনে তামা করে ফেলছে সেই দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ থেকে। তারাই একমাত্র পারমাণবিক বোমা ফেলে দুনিয়ায় দু’ দুটো শহর মুহূর্তে ধ্বংস করার রেকর্ডের মালিক। চাঁদে পা ফেলেছে পয়লা। ফলে অহংকার তাদের থাকারই কথা। তবে ট্রাম্প সাহেব সবাইকে টেক্কা দিয়ে চলেছেন গত তিন বছর ধরে।
আমরা যারা ট্রাম্প সাহেবের পো ধরে চলে অভ্যস্থ তারাও সে অহংকারে ভাগিদার হব সেটাই তো স্বাভাবিক। সেই সোহরাওয়ার্দী আমল থেকেই পাকিস্তান মার্কিনদের মোসাহেব। যদিও বিপদে কোনদিনই তারা পাকিস্তানের পক্ষে সাড়া দেয় নি, শুধু হুংকার আর অস্ত্র বিক্রি ছাড়া। নেহেরু নিজে ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রী ছিলেন। প্রথমে চেষ্টা করেছিলেন চীনের সাথে। হিন্দুস্তান-চীনী ভাই ভাই অনেক করেছেন। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে সে স্বপ্ন ভেঙে যায় নেহেরুর। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে রাশিয়া ঘেঁষা মানুষ হিসেবে তাঁর সুনাম-দুর্নাম দুটোই। তিনি সোভিয়ত ইউনিয়নের সাথে দোস্তি করে এক মিশ্র অর্থনীতির ভারত গড়তে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার সেই কংগ্রেস বিশ^ ব্যাংকের এক সাবেক অর্থনীতির প-িত মনোমোহন সিং-এর হাত ধরে মার্কিন তরিকায় ভারত আধুনিকায়নে পথ ধরলেন। সেই থেকে ভারত নাকি শুধুই বিকাশ ঘটাচ্ছে।
ভারত আর সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, আর্থিক এবং সর্বোপরি সামরিক সহায়তা না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় বিলক্ষণ বিলম্বিত হত। দল, বিশ^াস, কার্যকলাপ কোন ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে কোন সরকারই সমাজতন্ত্রের পথ মাড়ায় নি; কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির এক কাগুজে নীতি লেখা হল ‘সমাজতন্ত্র’। সে মাজেজা জাতি এখনও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। লুটপাটের এমন আজগুবি সমাজতন্ত্র দুনিয়া আজ পর্যন্ত চোখে দেখে নি, কানে শোনে নি। পঁচাত্তরের পর সে কাগুজে বাঘটাকেও সহজে বধ করা গেল।
তাহলে সাকুল্যে দাঁড়ালো এই, উপমহাদেশে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের জয় জয়কার। পশ্চিমা তাত্ত্বিকেরা গালভরা নাম দিতে ওস্তাদ। একে তারা বলে ‘নয়া উদারবাদ’। অবশ্য এই ‘নয়া উদারবাদ’ শব্দবন্ধের মোহন মায়ায় আমজনতা সায় দেয় নি কখনও। তাদের মনে গেঁথে আছে ‘সা¤্রাজাবাদ’ শব্দবন্ধটিই। তার বড় কারণ সা¤্রাজ্যবাদের ভয়ংকর রূপ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার চেয়ে আর কেউ জানে না। করোনা নিয়ে লিখতে বসে এসব প্যাঁচাল না পেড়ে উপায় নেই। তা এবার এই তিন দেশের করোনা মোকাবেলার হদিস নেয়া যাক। আমি কয়েক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। তা না হলে বিষয়টা ভাল করে বোঝা যাবে না। পয়লা তরিকা সংখ্যা দিয়ে। গতানুগতিক সংখ্যার আঁচড়। আজ (২৬ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টা) পর্যন্ত তথ্য নিয়ে সব হিসেব কষা হবে। তথ্যে নিয়েছি ওয়ার্ল্ডওমিটার ডট ইনফো থেকে।
করোনা এই উপমহাদেশে প্রথম পা ফেলে ভারতে ৩০ জানুয়ারি, পাকিস্তানে ২৬ ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশে ৮ মার্চ। আর করোনায় প্রথম মারা যায় ভারতে ১২ মার্চ ১ জন, পাকিস্তানে ১৯ মার্চ ২ জন, বাংলাদেশে ১৮ মার্চ ১ জন। এ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ভারতে ২৬,২৮৩, পাকিস্তানে ১২,৬৪৪, বাংলাদেশে ৪,৯৯৮।
করোনায় মোট মারা গেছে ভারতে ৮২৫, পাকিস্তানে ২৬৮, বাংলাদেশে ১৪০ জন।
প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার হিসেবে ভারতে ০.৬, পাকিস্তানে ১, বাংলাদেশে ০.৯ জনকে মারা গেছে।
মোট সুস্থ হয়েছেন ভারতে ৫,৯৩৯, পাকিস্তানে ২,৭৫৫, বাংলাদেশে ১১৩ জন।
মোট চিকিৎসাধীন আছে ভারতে ১৯,৫১৯, পাকিস্তানে ৯,৬২১, বাংলাদেশে ৪,৭৪৫ জন।
মোট শংকাজনক রোগী পাকিস্তানে ১১১, বাংলাদেশে ১ জন। ভারত বলছে, তাদের শংকাজনক রোগী একজনও নেই।
প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যায় গড়ে ভারতে ১৯, পাকিস্তানে ৫৭, বাংলাদেশে ৩০ জন আক্রান্ত হয়েছে।
ভারতে ৫,৭৯,৯৫৭, পাকিস্তানে ১,৩৮,১৪৭, বাংলাদেশে ৪৩,১১৩ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে।
এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে তুরস্কে (১০৭,৭৭৩) কিন্তু বেশি মারা গেছে ইরানে (৫,৬৫০)। আক্রান্তের হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে ইরান (৮৯,৩২৮)। তৃতীয় চীন (৮২,৮২৭) হলেও মৃতের হিসেবে চীন দ্বিতীয় (৪,৬৩২)। আক্রান্ত এবং মৃতের হিসেবে ভারতের অবস্থান চতুর্থ (২৬,৪৯৬ এবং ৮২৫) এবং পাকিস্তান ৮ম (১২,৭২৩ এবং ২৬৯)। বাংলাদেশ আক্রান্তের হিসেবে ১৬তম (৪,৯৯৮), কিন্তু মৃতের হিসেবে ১২তম (১৪০)।
পৃথিবীতে বাংলাদেশেই মৃতের সংখ্যা সুস্থ হয়ে ওঠার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু সবদেশে আরোগ্যের সংখ্যা মৃতের সংখ্যার অনেক অনেক বেশি। বিশে^ এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর হার মাত্র ৩.৪%, সেখানে বাংলাদেশে ১১৩%!!
কিন্তু এই হিসাবেও একটা শুভঙ্করের ফাঁক থেকে যাচ্ছে। আর তা হলো, সময়ের ব্যবধান। চীনে প্রথম করোনা সংক্রমণের খবর জানাজানির পর বাংলাদেশে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় পাক্কা দুই মাস ১৭ দিন পর। এত দীর্ঘ সময় আমাদের সীমাহীন নির্লিপ্ততা সবাইকে ক্ষুব্ধ করেছে। শুধু তাই নয়, এই দীর্ঘ সময়ে কর্তারা ভিন্ন এ্যাজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কোটি কোটি টাকার হাওয়াই বাজি ফুটিয়ে উৎসব করেছেন, মিথ্যাচার করেছেন, সমালোচকদের উপর চোখ রাঙিয়েছেন। দম্ভ করেছে, তারা নাকি করোনার চেয়ে শক্তিশালী!
কিন্তু যারা ফ্রন্ট লাইনে থেকে করোনা মোকাবেলা করবেন সেই সব চিকিৎসক, নার্স, সহায়ক স্বাস্থ্য কর্মী, এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার, বিদ্যুৎ, পানি, ওষুধ সরবরাহ, প্রশাসন, পুলিশ, ইত্যাদি জরুরি সেবাদানকারীদের সুরক্ষার কোন কাজই করে নি। কিন্তু শত শত কোটি টাকা তসরুফের অভিযোগ এন্তার। হাসপাতালগুলোকে জীবাণুমুক্ত ও নিরাপদ করার কোনই তৎপরতা চোখে পড়ে নি। অন্যদিকে শুধু আতংক ছড়ানো হয়েছে। ভয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগী হাসপাতাল থেকে পালিয়ে বাঁচার ভুল পথে হেঁেটছে। শুধু তাই নয়, ছোঁয়াছে রোগ করোনা সংক্রমণের প্রাথমিক কঠোর যে ব্যবস্থা জন সমাগম কমাতে আইনি ব্যবস্থা নেয় নি। লক ডাউন করে নি, কারফিউ জারি করে নি। বিদেশ থেকে আসা স্বদেশী বা বিদেশী কারো প্রতিই বিমানবন্দর, বা সীমান্তে উপযুক্ত স্ক্রিনিং, কোয়ারেন্টিন কিংবা প্রয়োজনী তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, নজরদারি করা হয় নি। এসব বিষয়ে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশ কিংবা দেশের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করে নি সরকার। শুধু তাই নয়, কোন খানেই কোন সমন্বয় বলে কিছু নেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানী বিজন শীলের উদ্ভাবিত টেস্ট কিট নিয়ে নানা কেলেংকারী করা হয়েছে। বহু নাটকের পর গতকাল সে কিট হস্তান্তর অনুষ্ঠানে সরকারের কোন প্রতিনিধিই উপস্থিত হয় নি। অথচ সারা দুনিয়ায় করোনা মোকাবেলায় এখন মরিয়া চেষ্টা চলছে। ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে সরকারগুলোর কুসংস্কারের সকল আলামত আলগা হয়ে পড়েছে। রাজনীতির কুচর্চা সকল সভ্য আচরণ, শিষ্টাচারকে অস্বীকার করে চলেছে। ভারতে গোমুত্র পান, গোবর শুকিয়ে খাওয়ার মত ঘটনা ঘটেছে গেরুয়া ধর্মান্ধ রাজনীতির শীর্ষ পর্যায় থেকে। পাকিস্তানের অক্সফোর্ডে পড়া ক্রিকেটার শিরোমনি প্রধানমন্ত্রী তার ধর্মান্ধ স্ত্রীর পরামর্শ মত করোনা মোকাবেলায় হাস্যকর ভূমিকার পালন করে চলেছেন। ট্রাম্পের মত মূর্খতার চূড়ান্ত্র প্রকাশ এখন বিশ^রাজনৈতিক নেতৃত্বের সর্বত্র।
চীনে করোনা ভাইরাসে চার জন পাকিস্তানী ছাত্র আক্রান্ত হলে সাথে সাথে বেলুচিস্তান প্রেেদশ লকডাউন করে ফেলে। পরে অন্যান্য প্রদেশেও। ভারত প্রথম জনতার কার্ফূ পালন করে এবং পরে দেশব্যাপী লকডাউন করে। কিন্তু বাংলাদেশ এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত লকডাউন করে নি। যে দেশে এই যুগে কোন রোগে মৃত্যুও হার ১১৩% সেই দেশে কী ধনরের পদক্ষেপ জরুরি সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের এই ভূমিকা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মানুষের জীবন নিয়ে অব্যবস্থাপনার চরম প্রকাশ ঘটছে।
সারা পৃথিবী যেখানে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ নিয়ে মহাচিন্তিত সেখানে আমাদের মাঠভরা ফসল। অথচ তা ঘরে তোলার কোন ক্রাস প্রোগ্রাম দেখা যাচ্ছে না। প্রণোদনা কাদের জন্য তা কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। প্রতিদিন প্রণোদনার টাকা, চার চুরির খবরে দেশ সয়লাব। এমন দলবাজি আর আমলা নির্ভরতা এদেশ অতীতে কখনো দেখে নি। কয়েক কোটি মানুষ এখন ভুখা। কাজ নেই কারো। মধ্যবিত্তের সংকট তীব্রতর হয়ে উঠছে। অব্যবস্থাপনার চরম। এভাবে চললে বিশৃঙ্খলার আশংকা বাড়ে।
পুরো কাজের ধারা সেই ইউরোপীয় মডেলে আর মার্কিন মহারাজ ট্রাম্প স্টাইলে। সেখানে পুঁজিবাদী মুনাফাই শেষ কথা। আতংক ছড়াও, মুনাফার রাস্তা বানাও। করোনা পুঁজিবাদী আর সমাজবাদী ধারণা ও কর্মধারার মধ্যে পার্থক্য আলগা করে দিচ্ছে। দেখা যাক, এ ফসল কে নিজের ঘরে তুরতে পারে।
আগামি কাল মহাদেশভিত্তিক আলোচনার ইচ্ছা রইল।
আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান