সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট ছাড়াই কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল!

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ গত এক মাসে দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৭০০ গুণ। গত ২৩ মার্চ শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ছয় জন, ঠিক তার একমাস পর (২৩ এপ্রিল) শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চার হাজার ১৮৬ জনে। এসব রোগীর শতকরা ৮০ ভাগের হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, তবে বাকি ২০ শতাংশের আগে থেকেই মারাত্মক ও জটিল রোগ থাকার কারণে তাদের পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ে। এজন্য তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এদের বেশিরভাগকেই অক্সিজেন দেওয়ারও প্রয়োজন হয়। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে শুধুমাত্র কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত (ডেডিকেটেড) হাসপাতালগুলোর বেশিরভাগেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট নেই। যে দুয়েকটি হাসপাতালে সেন্ট্রাল প্ল্যান্ট আছে, সেগুলোতে আবার ওয়ার্ডের বেডে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই, রোগীর অবস্থা নাজুক হলে শুধু অক্সিজেন দিতে হলেও তাকে নিতে হয় আইসিইউ বা সিসিইউতে। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে আরও জানা যায়, এসব হাসপাতালে ১৯২টি ভেন্টিলেটর দেওয়া হলেও তাতে আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ১৩৩টি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ আক্রান্ত জটিল রোগীদের মধ্যে যাদের আইসিইউতে নিতে হয় সে হারও কমিয়ে আনা সম্ভব, যদি প্রতিটি বেডের সঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ থাকে। আর অক্সিজেন সরবরাহ যখন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না (ফেইল করে) তখনই দরকার হয় ভেন্টিলেটর। তবে এসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দৃঢ় বিশ্বাস, যদি অক্সিজেন সাপ্লাই ঠিক থাকে, তাহলে ভেন্টিলেটর পর্যন্ত যাওয়ারই দরকার হয় না। তাই কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে প্রথমেই দরকার হয় অক্সিজেন। রাজধানী ঢাকাতে ১৯টি এবং ঢাকার বাইরে ৮ বিভাগেও অনেক হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করেছে সরকার। অথচ করোনার জন্য প্রথম প্রস্তুত করা কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল−এ দুটি হাসপাতালেই এখনও নেই কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা। বাকি হাসপাতালগুলোর আনুষঙ্গিক অনেক সুবিধা আগে থেকেই নেই, কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা তো পরের কথা। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার জানান, ঢাকার বাইরে অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে ৩ হাজার ২০০টি, যদিও এসব হাসপাতালে দরকার আরও ৩ হাজার ৪৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার।
কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহ রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি হাসপাতালে জানিয়ে বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, ‘এসব হাসপাতালেও সেন্ট্রাল অক্সিজেনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এই অক্সিজেন সাপ্লাইটাই নিরবচ্ছিন্নভাবে সব বিভাগে চাইলেও পাওয়া যাচ্ছে না।’ ‘সব রোগী আইসিইউতে যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাই ওয়ার্ড লেভেলে অক্সিজেন সরবরাহ থাকতে হবে, সেটা না করা গেলে সেন্ট্রাল অক্সিজেন থেকেও লাভ নাই।’ দেশে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকেই হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু যে দুটো হাসপাতালকে এখন পর্যন্ত সর্ম্পূণভাবে ডেডিকেটেড করা হয়েছে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের জন্য, সে দুই হাসপাতাল কুয়েত মৈত্রী ও কুর্মিটোলাতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট ছাড়া এসব হাসপাতালে মেনিফোল্ড দিয়ে প্রাথমিক ধাক্কা কাটানো যাবে হয়তো, কিন্তু যখন রোগী বেশি হবে তখন সিলিন্ডার দিয়ে ভেন্টিলেটর চালানো যাবে না, কারণ ভেন্টিলেটর চালাতে হলে ‘হাইফ্লোর’ অক্সিজেন দরকার। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মন্তব্য, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের সেসব হাসপাতালকেই ডেডিকেটেড করা উচিত ছিল, যেখানে এসব সুবিধা রয়েছে। যেসব হাসপাতালে প্রপার প্ল্যান্ট রয়েছে, ওয়ার্ড পর্যন্ত যাদের সেন্ট্রাল সাপ্লাই রয়েছে সেসব হাসপাতালে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা হলে সবদিক দিয়েই ভালো হতো, নিরাপদ হতো।
যন্ত্র ছাড়াই স্থাপন আইসিইউ
আবার যে ১৭টি হাসপাতালে ভেন্টিলেটর মেশিন স্থাপন করা হয়েছে তাতে আইসিইউ বেডের ঘাটতি রয়েছে ৫০টি, এবিজি মেশিন উইথ গ্লুকোজ অ্যান্ড ল্যাক্টেট ঘাটতি রয়েছে ১৭টিতে। আবার এসব ভেন্টিলেটরকে পুরোপুরি কার্যকর করতে, অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে অক্সিজেন সিলিন্ডার দরকার ৮৫টি। কারণ কোনও রোগীর যদি অক্সিজেনের মাত্রা ৯০ শতাংশের নিচে নেমে যায় তাহলে তাকে অবশ্যই অক্সিজেন দিতে হয়। জানা যায়, ঢাকার ডেডিকেটেড করা হাসপাতালগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে ১০টি হাসপাতালে, বাকিগুলোতে সিলিন্ডার রয়েছে দুই হাজার ৫৮৩টি।
কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে ছিল না বাজেট
কোভিড-১৯ এর জন্য প্রথম ডেডিকেটেড কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে বেড ২৮টি থাকলেও বাস্তবে চালু রয়েছে ১০টি, বাকি বেডগুলো এখনও চালু করা যায়নি, ভেন্টিলেটর রয়েছে ১০টি। এখানে অক্সিজেনের কোনও ব্যবস্থাই ছিল না উল্লেখ করে সূত্র বলছে, শুধু ওয়ার্ডটাইপ সিলিন্ডার দিয়ে অক্সিজেনের ব্যবস্থা ছিল। পরে যখন আইসিইউ করা হয়, তখন সেখানে মেনিফোল্ড করা হয়েছে। বর্তমানে এ হাসপাতালে ১২৩টি অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আলীমুজ্জামান বলেন, ‘এ হাসপাতালে কিচ্ছু ছিল না, ছিল না বাজেট। আমরা সেসব শুরু করেছিলাম, কিন্তু ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ এসে পড়ায় এই প্রথম বরাদ্দ পাওয়াতে ধীরে ধীরে সবকিছু করা হচ্ছে। তবে আইসিইউর জন্য চিকিৎসক রয়েছেন ১২ জন আর নার্স রয়েছেন ২৭ জন।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, ইন্টারন্যাশনাল গাইডলাইন অনুযায়ী প্রতি বেডের জন্য চারটি করে সিরিঞ্জ পাম্প থাকার কথা থাকলেও এখানে দশটি বেডের জন্য রয়েছে একটি করে।
একাধিকবার চিঠি দিয়েও প্ল্যান্ট হয়নি কুর্মিটোলায়
এদিকে আরেক ডেডিকেটেড হাসপাতাল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেন্ট্রাল হাসপাতাল পাইপলাইন থাকলেও সেখানে মেনিফোল্ড সিলিন্ডার দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা বলেন, এরকম একটা হাসপাতালের জন্য অবশ্যই অক্সিজেন প্ল্যান্ট দরকার। বিকল্প হিসেবে লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক আছে, এখানে অক্সিজেন রাখা হয় এবং সেখান থেকে পাইপলাইন দিয়ে হাসপাতালের আইসিইউ, সিসিইউসহ সব জায়গাতে সাপ্লাই করা হয়। কিন্তু এটা সবসময় আইডিয়াল না। সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট না থাকার কারণে সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয় বলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সবাইকেই। অথচ এখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর জন্য জায়গারও কোনও অসুবিধা নেই। খোঁজ নিয়ে যায়, এই হাসপাতাল থেকে একাধিকবার সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্টের জন্য একাধিকবার স্বাস্থ্য অধিদফতরে চিঠি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এটা হয়নি এখনও।
‘‘এ হাসপাতালে বর্তমানে ৩৫৯টি অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলেও সিলিন্ডার কোনোভাবেই ‘আইডিয়াল’ না কোভিড হাসপাতালের জন্য’’−এমন মন্তব্য করে হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কোভিড নিয়ে ভর্তি হবে ‘রেসপিরেটরি ডিসট্রেস’এর রোগীরা। তখন এটা আসলেই খুব ‘ডিফিকাল্ট’ হবে আমাদের জন্য, বলছেন চিকিৎসকরা। তারা বলেন, একটা সময়ে এসব সিলিন্ডার যখন শূন্য হতে থাকবে তখন সেগুলো সরিয়ে নিয়ে নতুন এনে লাগাতে হবে, এটা খুব সহজ কোনও কাজ নয়। অথচ এটা যদি ‘সেন্ট্রালি’ থাকতো, তাহলে এগুলো সহজ হতো। করোনার জন্য ডেডিকেটেড করা মহানগর হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে ৪৮টি, মিরপুরের লালকুঠি হাসপাতালে আছে ২০টি। অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, হাতে গোনা কয়েকটি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট থাকলেও অন্য হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন মেনিফোল্ড। আবার সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট থাকলেও কেবলমাত্র আইসিইউ, এনআইসিইউ, সিসিইউ, পোস্ট অপারেটিভসহ কয়েকটি জায়গাতে সীমাবদ্ধ জানিয়ে বলেন ওগুলো ওয়ার্ড পর্যন্ত নাই।
জানা গেছে, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের কোনও সরকারি হাসপাতালেই ওয়ার্ডে অক্সিজেন সরবরাহ হচ্ছে না। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, মেনিফোল্ড অক্সিজেন সরবরাহ দিয়ে হয়তো অন্য সময়ে সামাল দেওয়া যায়, কিন্তু যদি কোভিড আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা একসঙ্গে অনেক বেড়ে যায় এবং তাদের অবস্থা ক্রিটিক্যাল হয়, তাহলে এই প্রস্তুতি নিয়ে রোগী সামাল দেওয়া ভীষণ কঠিন হয়ে যাবে। এখন এ অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব কিনা আমি জানি না, তবে উদ্যোগ অন্তত নেওয়া উচিত। আর এসব বিষয়ে জানতে একাধিকবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদকে ফোন দিলেও তিনি না ধরায় তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।