দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া : ভুটানের করোনা মোকাবেলা

0
আমিরুল আলম খান
ভুটানে একজনও করোনায় মারা যায় নি। অথচ করোনাজ্বরে দুনিয়া পুড়ে মরছে। তার সব বড় খবরই আবার দূর দেশের। পয়লা চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর, ইরান। তারপর ইউরোপের ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, বিটেন, কার্মানী, নেদারল্যান্ড, রাশিয়াসহ উন্নত প্রায় সব দেশ। তারপর আমেরিকা নিয়ে মাতামাতি। সেখানে শুধু মড়ার মিছিল। পশ্চিমা মিডিয়ার অন্ধ অনুসারী এদেশের মিডিয়াও শুধু আতংক ছড়াচ্ছে। কিন্তু যেখানে জীবনের গান শোনা যাচ্ছে, লড়ছে যারা বীরের মত তাদের খবর নেই আমাদের মিডিয়ায়। কিউবার কথা নাই বা বললাম। সে তো অনেক দূরের দেশ। চীনের পড়শি লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ভুটান, নেপাল, মঙ্গোালিয়া, কিরগিজ কিংবা সার্কভুক্ত শ্রীলংকা, আফগানিস্তান, মালদ্বীপের কথাও কেউ বলছে না। বাড়ির পাশে আরশি নগরের খোঁজ রাখি না কেউ। আমরা এসব লড়াকু দেশের গল্প শোনাতে চাই। না, না, গল্প নয়, গল্প নয়, সত্যি কাহিনী।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত সবচেয়ে বড় দেশ। তারপরই পাকিস্তান। আমাদের প্রায় চারপাশেই ভারত। দক্ষিণ-পূর্বে এক চিলতে সীমান্ত মায়ানমারের সাথে। কিন্তু তারপরই একেবারে কাছের দেশ ভুটান। বাংলাদেশ থেকে ভারতের মধ্য দিয়ে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে। মাত্র ৩৮,৩৯৪ বর্গকিলোমিটারের ছ্ট্টো পাহাড়ী দেশ। জনসংখ্যা মাত্র ৮ লাখ। পানি বিদ্যুৎ তার প্রধান আয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পাশের দেশে রপ্তানি করে বেশ মোটা টাকা আয় করে ভুটান। ফসল তেমন ফলে না। তেমন জমি নেই। তবে ফল আছে। হিমালয়ের গায়ে বেশ শীতের দেশ। জীবনযাত্রা কঠিন। চলাচল আরও কঠিন। ঘোড়া, গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে চলাচল কিংবা মালামাল বহন করতে হয় বেশির ভাগ এলাকায়। কিন্তু তা হলে কী হবে? ভুটানকে বলা হয় ‘সুখের দেশ’। ভুটান একমাত্র দেশ যারা জিডিপি দিয়ে মানুষের মন ভোলায় না। আট মানদÐে সুখ-শান্তির নিকেশ কষে। আসলেই তারা সুখি মানুষ। জীবিকা কঠিন। কিন্তু মনের আনন্দ অঢেল। জীবের প্রতি অশেষ ভালোবাসা। নদী ঝর্নায় মাছের অন্ত নেই। কিন্তু কেউ সে মাছ মারবে না। খাওয়াদাওয়া খুবই সাধারণ। নিরামিশই পছন্দ। সততা আর মানবতা দিয়ে জীবনকে সুখি রাখে। করোনাকালে এই ভুটান আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে আসার কারণ অনেক। সে কথাই বলব আজ।
তার আগে একটা দামী কথা বলে নিতে হবে। আমাদেও স্বাধীনতা যুদ্ধে ভুটানই সবার আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। তারপর ভারত স্বীকৃতি দেয় ৬ ডিসেম্বর। অবশ্য এর পিছনে ছিল ভারতীয় কূটনৈতিক কৌশল। ভুটানের মানুষ গরিব বটে। তবে তাদের মাথাপিছু গড় আয় আমাদের প্রায় ছয়গুণ বেশি, ৯,৪২৬ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশে ১৩৬৩ ডলার)। আর শিক্ষিতের হার প্রায় ৬০ শতাংশ (বাংলাদেশের প্রায় ৭৩%)। স্থলবেষ্টিত দেশটি দীর্ঘকাল ধরে ভারতের সাথে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। তখন ছিল রাজতন্ত্র। ২০০৪ সাল থেকে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হয় রাজা ওয়াংচুকের ইচ্ছায়। দেশটির শিক্ষা বা স্বাস্থ্যব্যবস্থা দুর্বল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লোটে শিরিং বাংলাদেশে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হন। তিনি এখনও নিয়মিত রোগী দেখেন। তবে কোন ফিস গ্রহণ করেন না। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ ভুটান। আইনের শাসনই এর মূল রক্ষাকবচ।
পাহাড়ী এই দেশে একটাই মাত্র ছোট্ট বিমান বন্দর আছে। নাম পারো। সেটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কেবলমাত্র ভুটানের এয়ার লাইনার ড্রুক এয়ারের এখানে ওঠানামার অনুমতি আছে। রাজধানী থিম্ফু আর পুনাখা ছাড়া বাকি অঞ্চল দুর্গম। তবে পাহাড়ের গায়ে খুবই উন্নত সড়ক তারা নির্মাণ করেছে।
ভুটানের বৈদেশিক আয়ের দ্বিতীয় উৎস পর্যটন। তবে শুধু অর্থের জন্য পর্যটনে তারা বিশ^াসী নয়। তাদের পর্যটনের প্রথম ও প্রধান নীতি হল পরিবেশ সংরক্ষণ। তাই তারা পর্যটকের সংখ্যা কমাতে সব সময় তৎপর। অন এ্যারাইরাল ভিসা চালু থাকলেও তা খুবই কড়াকড়ি। সার্ক দেশগুলোর জন্য কিছুটা শিথিল থাকলেও এ বছর জানুয়ারি থেকে তাও তুলে দিয়েছে। এমন একটা দেশ করোনায় আক্রান্ত হবে এমন আশংকা ছিল প্রথম থেকেই। বিশেষ করে ভুটানের সাথে চীন এবং ভারতের সীমান্ত রয়েছে। চীনের সীমান্ত দুর্গম হলেও ভারতের সাথে তার সীমান্ত এমনই যে, সীমান্ত বন্ধ করলে ভুটান প্রায় অচল হয়ে পড়ে। সেই ভুটান করোনা সংক্রমণ রোধে দুনিয়ায় বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। ভুটানে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৬ মার্চ। বান্ধবীকে নিয়ে ৭৬ বছর বয়সী এক মার্কিন প্রবীণ পর্যটক ভারতের আসাম হয়ে ভুটানে প্রবেশ করে। তখন তার শরীরে করোনার কোন লক্ষণ পাওয়া যায় নি। থিম্ফুতে অসুস্থ বোধ করলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু তেমন সমস্যা না থাকায় তিনি পুনাখা সফরে যান। তারপরই দেহে করোনা শনাক্ত হয়। এরপরই ভুটান সর্বাত্মক সতর্কতা জারি করে। বিদেশীদের ভুটানে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। বান্ধবীকেও কোয়ারেন্টিন (ঘরবন্দি) করা হয়। তার গাইড, ড্রাইভারসহ এমন ৯০ জনকে খুঁজে বের করা হয় যারা কোন না কোনভাবে তার সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাদেরও আলাদা করে (ঘরবন্দি) নজরদারি শুরু হয়। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৪ দিন ছুটি ঘোষণা করে। রাজধানী থিম্ফু পুরো লকডাউন করে ফেলে। ১৩ মার্চ পুরুষ পর্যটককে বিশেষ ব্যবস্থায় আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ১৪ দিনের মাথায় ২০ মার্চ তার ৫৯ বছর বয়সী বান্ধবীরও করোনা ধরা পড়লে তাকে পুনরায় ঘরবন্দি রেখে আরও ১৪ দিন চিকিৎসা দেয়া হয়। প্রথম ১৪ দিন ঘরবন্দি থাকার পর গাইড ও ড্রাইভার করোনামুক্ত প্রমাণিত হলেও তাদের আরও ৭ দিন পর্যবেক্ষণে রাখে কর্তৃপক্ষ। রাজা জিংমে কেশর নামগিয়েল ওয়াংচুক ২২ মার্চ সকল সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করেন। তবে ভারতের পশ্চিম বাংলান জয়গাঁওতে আটকে পড়া প্রায় ৫,০০০ ভুটানিকে দেশে পিরিয়ে ফুনশোলিং-এ বিশেষ ব্যবস্থায় রাখে। ভারত থেকে পান, সুপারিসহ যাবতীয় ফল, সবজি, মাংস আমদানি নিষিদ্ধ করে। ব্রিটেন থেকে ফেরা একজন ছাত্র ২৫ মার্চ তৃতীয় করোনা রোগী হিসেবে শনাক্ত হয়। ৩১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং ঘরবন্দির সময় ১৪ থেকে ২১ দিনে বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। ২ এপ্রিল পর্যন্ত ভুটানে মাত্র ৫ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয় আর সন্দেহভাজন ৩,০০০ মানুষকে ঘরবন্দি রাখা হয়। এ পর্যন্ত একজন রোগীও মারা যায় নি, ২ জন সুুস্থ হয়েছেন এবং মাত্র ৩জন চিকিৎসাধীন আছে। করোনা মোকাবেলায় ভুটান যে তড়িৎ ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পেরেছে, আমরা তা পারি নি। ভুটানের প্রতিবেশী নেপালের সাফল্যও তেমনি উজ্জ্বল। এ পর্যন্ত নেপালেও কেউ করোনায় মারা যায় নি। আগামী কাল নেপালের করোনাযুদ্ধ নিযে আলোচনা করার ইচ্ছে রইল।
আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
amirulkhan5252@gmail.com