করোনাকালে আসুন, জাগরণের গান গাই

0
আমিরুল আলম খান
আমরা আজকাল যাকে গণমাধ্যম বা মিডিয়া বলতে পাগল তা কিন্তু পুঁজিবাদের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। ফরাসি বিপ্লবের আগে পুঁজি সঞ্চয়ের প্রথম পর্বেই তার উত্থান এবং পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে তার বাড়বাড়ন্ত। গণতন্ত্রের চার নম্বর খুঁটি হিসেবে তখন বুঝানো হত সংবাদপত্রকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে তার এত বেশি রূপান্তর ঘটেছে যে তাকে এখন চেনাই কঠিন হয়ে গেছে। দুনিয়ার প্রথম খবরের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থা হিসেবে সেই যে রয়টার্স পণ্য, জাহাজ আর শেয়ার বাজারের খবর দিতে শুরু করল এখনও মিডিয়ার আসল কাজ কিন্তু সেটাই। সোজা কথায়, বেচাবিক্রির দুনিয়ার খবর দেয়া। তাতে মুনাফা যাবে ব্যবসায়ীর পকেটে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভোক্তা দেখল সেও তো সহজে পেয়ে যাচ্ছে দরকারি সব জিনিসপত্রের খবরাখবর। তাই তারাও হামলে পড়ল এই খবরের কাগজে। তাতে শাসকগোষ্ঠিীর নিজেদের ফরমান জারির সহজ সুযোগ পেয়ে তারাও এটা তাদের শাসনের জন্য মহামূল্যবান এক অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগাতে শুরু করল। আর প-িতদেরও নিজেদের কথা সহজে লোকের কাছে পৌঁছে দেয়া সহজ হয়ে গেল। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী সবাই হামলে পড়ল এই খবরের কাগজের দিকে। শিক্ষাবিদ আর ধর্মপ্রচারকরা দেখল ধর্ম প্রচারের এক মহা সুযোগ এসে গেছে হাতের মুঠোয়। এক কথায় সবাই নিজেদের মত করে এর মহিমা কীর্তন করতে শুরু করল।
কিন্তু সব সময় খবরের কাগজ সবারই শুধু লাভের কারণ তা কিন্তু নয়। দেখা গেল, অনেক কিছুতেই কিছু লোকের যেমন লাভ, কারো আবার কিছু লোকসানও হয়। তাই কিছুদিনের মধ্যেই খবরের কাগজ সবারই প্রিয় রইল না। কখনও রাজার লাভ যদি ষোলো আনা, প্রজার তাতে সর্বনাশ। কখনও বণিকের মুনাফার পাহাড় হলেও সাধারণ মানুষের সর্বনাশ। কিন্তু মোটাদাগে লাভে-ক্ষতিতে খবরের কাগজের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েই গেল। গোড়ায় শুধু বণিক যে লাভ খুঁজত কৌশলে তারা অন্যকে এর মধ্যে সামিল করে দিতে পারল।
কিন্তু পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে লেখক, চিন্তাবিদ, রাজনৈতিক দলগুলো যখন এই কার্যকর কামানটা নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে শুরু করল তখন রাজতক্তে আসীন রাজা আর ধর্ম নিয়ে ব্যবসায়ীরা পাদরি, যাজক, আলেমরাও বিপদ টের পেল। তারাও সুযোগ পেলেই হুঙ্কার ছাড়তে শুরু করল। রাজা আর পোপগণ নানা ফরমান জারি করে খবরের কাগজের হাত খাটো করতে চেষ্টা করে। কিন্তু ততদিনে খবরের কাগজের শিকড় চলে গেছে মাটির অনেক গভীরে। আর গত প্রায় পাঁচ শ’ বছরে এর এত রূপান্তর ঘটেছে যে, তাকে আগের মত করে চেনাই কঠিন। যন্ত্রের আবিষ্কার, যোগাযোগ ব্যবস্থার বিস¥য়কর উন্নতি তো আছেই, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, টেলিপ্রিন্টার, টেলেক্স, ফ্যাক্স, রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট ইত্যাদি আবিষ্কার গোটা ব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছে। স্বাধীন ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা ভারতের মত উপনিবেশগুলোতেও খবরের কাগজের পক্ষে প-িতদের কলম যুদ্ধ করতে হয়েছে। তাই তাকে সহজে উপড়ে মেরে ফেলা গেল না। কিন্তু যুগে যুগে খবরের দুনিয়াকে কবরে পাঠানোর চেষ্টা সবদেশেই হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এত চেষ্টার পরও খবরের কাগজ বা এ যুগের মিডিয়া স্বীকৃতি পেয়েছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবেই।
তবে, যা কিছুই ঘটুক, মিডিয়া শেষ পর্যন্ত শাসক আর বণিক শ্রেণীরই হাতিয়ার রয়ে গেছে। সে এক ভীষণ মারণাস্ত্র এখন। তুলনায় প্রায় এটম বোমার সমান। সে অস্ত্রের কোপে সাধারণ মানুষ বলি হয় সবচেয়ে বেশি। সোজা কথায়, মিডিয়া আখেরে লাভ তুলে দেয় শাসক আর বণিকের গোলায়। এরা আবার প্রায় সময়ই হরিহর আত্মা। তাই বলে, কখনও সখনও মান-অভিমান যে হয় না তা কিন্তু নয়। তবে সে তরজায় এ কালের ট্রাম্প বাহাদুর যে খেল দেখাচ্ছেন তার জুড়ি সত্যিই নেই। সে কেচ্ছা পরে বলা যাবে। আপাতত, এই বিশাল বাণিজ্যের পয়লা কলমাটা বলি। সেটা দারুণ। ‘খারাপ খবরই আসল খবর’ (ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ)। এ কলেমা না পড়লে খবরের লোক হওয়া যাবে না। খবরের জগতে যারা পুরুত ঠাকুর তারা এই কলমা পড়িয়েই তরুণদের এ ব্যবসায় নামান। অর্থাৎ খদ্দেরের চোখে কিংবা কানে শুধু খারাপ খবরের বন্যা বইয়ে দাও। ব্যাস। তাতেই ব্যাংকে টাকার পাহাড় জমবে। এ কাজে যার যত মুন্সিয়ানা তিনি তত বড় সাংবাদিক। যে হাউজ যত বেশি খারাপ খবর যত তাড়াতাড়ি দুনিয়ায় ছড়াতে পারবে সেই হল দুনিয়ার সেরা।
খবর নিয়ে যারা খোঁজ খবর রাখেন তারা জানেন, মানুষের মনস্তত্ত্ব বড় অদ্ভুত। খারাপ খবর সে পছন্দ করে। তার চেয়ে বড় কথা তারা খারাপ খবর দ্রুত ছড়িয়ে আনন্দ পায়। তখন খবরের হাত-পা, ডানা গজায়। আসল খবরে খাদ ঢুকে যায়। শেষে আসলের চেয়ে খাদ বেশি হয়ে পড়ে। আসল খবর হারিয়ে গিয়ে তখন এই খাদ নিয়েই তরজা শুরু হয়। একই কথার নানা প্যাঁচালে তামাম দুনিয়া মেতে উঠে। একবার সেটা জমে উঠলে খবর বণিকদের পোয়া বারো। তাই খবরের লোকেদের কাজ হল খারাপ খবর খুঁজে আনা। একান্ত কিছু না পেলে পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে বাজার মাত করে রাখা। কিন্তু মানুষের মন যাতে ক্লান্ত না হয় সে জন্য তাদের আরেকটা হাতিয়ার মজুদ রাখতে হয়। সেটাকে খবরের জগতের লোক খুব গালভরা এক নামে ডাকে। সেটা আমেরিকার ল্যাবে তৈরি। সেখান থেকে ইউরোপ ঘুরে আমাদের এই হাভাতের দেশেও হাজির। ডেভনিউজ। অর্থাৎ, উন্নয়ন খবর। এই উন্নয়নের খবর হল চিকিৎসাবিদ্যায় যাকে বলে ’কোরামিন’ বা হাল আমলে যাকে বলে ‘লাইফ সাপোর্ট’। এটা খুব ধন্বন্তরী। প্রাচীন গ্রিস বোধহয় এই কোরামিন বা লাইফ সাপোর্ট বিষয়টাই গুরুত্ব দেয় নি। অথবা দিলেও এ অধমের চোখে পড়ে নি। তবে সেই প্রাচীন কালে মহাপ-িত এ্যারিস্টটল ট্রাজেডির মাহাত্ম্য বর্ণনায় শল্যচিকিৎসাবিদ্যা থেকে ধার করেছিলেন ‘ক্যাথারসিস’ শব্দটি। এরচেয়ে যুৎসই শব্দ তিনি খুঁজে পান নি। মানে হল, যন্ত্রণা লাঘবে ফোঁড়া কেটে পূঁজ বের করে দেয়া। সেকালে এ্যানেসথেসিয়া বা অবশ করার ওষুধ মানুষ জানত না। তাই কাটাছেঁড়ার সময় মানুষ যে যন্ত্রণা পেত তাতে মনে করত মরে যাওয়াই ভাল। কিন্তু এই যন্ত্রণা শেষে সেরে উঠে ডাক্তারের কুর্নিশ না করেই বা উপায় কী ছিল?
যুুদ্ধ, মহামরী, দুর্ভিক্ষ বলুন কিংবা রাজনৈতিক হানাহানি, সবেতেই খবরের লোকেদের কাজ কিন্তু খুঁজে খুঁজে খারাপ কথা বের করে আনা। ভাল খবরও তারা দেবে বটে। তবে তার আলাদা তরিকা। পয়লা দেখবে, সে খবরে কর্তার লাভ কতটা। লাভের অংক যত বেশি হবার সম্ভাবনা, মিশেল দিয়ে দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তা প্রচার করবে। যেমন জিডিপির খবর, বরাদ্দের খবর। সে সাথে ফটো সেশন। আবার একেবারে হতাশ হলে মানুষ খবরের দিক থেকে চোখকান সরিয়ে নেবে। তাই শোনাবে আষাঢ়ে গল্প। সেগুলো আবার তৈরি হবে ট্রিলিয়িন ট্রিলিয়ন ডলারের কারখানায়। অনেকটা সেই বর্গি আমলের গল্পের মত। “ধান ফুরালো, পান ফুরালো, খাজনা দেব কিসে? আর ক’টা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।” কিন্তু কে না জানে, ধান-পানের মত রসুনও ফুরিয়ে যাবে, চাষার খাজনা শোধ করার সামর্থ্য হবে না। মানে হল, করোনার জন্য যে ওষুধ তৈরি হবে তা যাদেরই কাজে লাগুক, গরিবের কাজে লাগতে লাগতে তিন বছর। তাতে মরবে কত আদম সন্তান? আমেরিকার সাদা প-িতরা বলছে ছয় কোটি। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে কম করেও পাঁচ কোটি মানুষ মরেছিল। আর আমেরিকা আর দস্যুরা বোমা ফেলে ভিয়েতনাম, কাশ্মিও, প্যালেস্টাইন, শ্রীলংকা, আফগানস্তান, ইরাক, লিবিয়া, ইরান, ইয়েমেন, সিরিয়া, বসনিয়া, সুদান আরও কত দেশে কত কোটি মানুষ মেরেছে? মারছে? এত কথা যে লিখছি তার কারণ একটাই। দুনিয়া জুড়ে এখন করোনার আতংক ছড়ানো হচ্ছে। কিন্তু আড়ালে রাখা হচ্ছে দুনিয়ার হাজারো কারোনা জয়ের কাহিনী। কারণ সে কথা বললে, বণিকের বাণিজ্যে লোকসানের ভয়। তাছাড়া এমন মওকা তো আর হররোজ আসবে না। মহামারী প্রায় নিয়ম মেনে এক শ’ বছর পরে আসে। কাজেই এই শতবর্ষের বাণিজ্যটা করে নিতে তামাম দুনিয়ার মুনাফাখোররা উঠেপড়ে লেগেছে। আমরা কি তাই সুখবরের সন্ধান করতে পারি না? পারি না সাধারণ মানুষের কাছে সেই সব সত্যি কাহিনি পৌছে দিতে যাতে মানুষের মনোবল বাড়ে; বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনতে পারে? সে জন্য দরকার জাগরণের গান গাওয়া।
আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান