মহামারি বাংলাদেশের অর্থনীতির কতখানি ক্ষতি করবে?

0

আনন্দ কুমার॥ মহামারির কারণে কি বাংলাদেশের অর্থনীতি লাইনচ্যুত হবে? হ্যা, কিন্তু সেটা কতখানি খারাপ হবে তা নির্ভর করছে ঢাকা এবং বাকি বিশ্ব কীভাবে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তার ওপরে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সবথেকে বড় ভিত পোশাক শিল্প। আর এ শিল্পের জন্য প্রয়োজন শ্রম যা বাংলাদেশে সস্তায়ই পাওয়া যায়। শ্রমিকের প্রাচুর্যতা থাকার কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম শ্রম রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক আয় হয়ে থাকে এ খাত থেকে। গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে ছিল দারুণ স্থিতিশীল। ফলে খুব দ্রুত এগিয়েছে দেশের অর্থনীতি। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল গড়ে ৮ শতাংশ। এবং এটি এমন একটি সময়ে হয়েছে যখন বাকি বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে আসছিল।
তবে চীনের পরেই পৃথিবীর সবথেকে দ্রুত বর্ধনশীল এই অর্থনীতি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে থেমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবথেকে বড় ভূমিকা রাখে পোশাক শিল্প ও প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স। এরমধ্যে, তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান জিডিপির ১৩ শতাংশের বেশি। এই খাতে কাজ করে ৪০ লাখের বেশি মানুষ। তবে ইতিমধ্যে প্রায় দশ লক্ষাধিক শ্রমিক চাকরিচ্যুত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সবথেকে বেশি পোশাক কিনে থাকে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালি। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে এসব দেশে সব ধরণের ব্যবসা বাণিজ্য প্রায় বন্ধ। মন্দার কারণে সেসব দেশের মানুষ পণ্যের ক্রয়ও থামিয়ে দিয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। রপ্তানিকারকরা তাদের বিক্রির অর্থ পাচ্ছেন না। ক্রেতারা প্রতিদিন তাদের অর্ডার বাতিল করছে। ফলে গার্মেন্টসের মালিকরা তাদের শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছে না। বেকার শ্রমিকরা তাদের গ্রামগুলোতে ফিরে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের গ্রাম অর্থনীতির ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে।
এরফলে, ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা। প্রবাসী শ্রমিকদের থেকে পাওয়া অর্থ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার আরেকটি বড় উৎস। বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৮ সালে প্রবাসী আয় থেকে প্রায় ১৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। যা পূর্বের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। ২০১৭ সালে শ্রমিকরা বিদেশ থেকে পাঠিয়েছিল ১৩.৫ বিলিয়ন ডলার। শ্রমিকদের থেকে হওয়া আয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। সবার আগে রয়েছে ভারত ও এরপরে রয়েছে পাকিস্তান। বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি কাজ করেন। তাদের বেশিরভাগই উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে কাজ করেন। একটা বিশাল অংশ রয়েছেন পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে। কিছু বাংলাদেশি কাজ করছেন, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরেও। তবে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে খারাপ হওয়ার কারণে তাদের একটা বড় অংশ দেশে ফিরে আসছে। এসব বিদেশ ফেরতরাও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। যতদিন বিশ্বের অবস্থা স্বাভাবিক না হয় ততদিন এইসব শ্রমিকরা তাদের স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্রেও ফিরতে পারবে না।
পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উৎসব। এ সময়ে দেশের ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারিত হয়। মানুষ প্রচুর কেনাকাটা করে থাকে। কিন্তু মহামারির কারণে মানুষ এ বছর কিছুই কেনাকাটা করতে পারেনি। এরফলে বাংলাদেশের স্থানীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যদিও কিছু ব্যবসায়ী অনলাইনের মাধ্যমে ব্যবসা করার চেষ্টা করছে কিন্তু এটি কোনোভাবেই স্বাভাবিক অবস্থার মত অর্থনীতিকে গতিশীল করতে পারছে না। মার্চ মাসে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক জানিয়েছিল, সবথেকে খারাপ অবস্থায় বাংলাদেশের জিডিপি ১.১ শতাংশ কমে আসবে। অর্থাৎ প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি থেকে ৩.০২ বিলিয়ন ডলারের প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। তবে এডিবি পরে আবার জানায়, বাংলাদেশে প্রায় ৯ লাখ মানুষ চাকরি হারাবে। তবে দুঃখজনক হল, শুধু গার্মেন্টস খাতেই এর থেকে বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার মহামারির কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে বড় ধরণের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর পরিবার বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা। রপ্তানি খাতের জন্যই ধরা হয়েছে প্রায় ৫০ বিলিয়ন টাকা বা ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পুরো প্রণোদনা প্যাকেজটি জিডিপির ২.৫২ শতাংশ। তবে পোশাক খাতের রপ্তানি ও প্রবাসী শ্রমিকদের থেকে পাওয়া অর্থ কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে তা নির্ভর করছে বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতি কত দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসছে তার ওপর। তবে এখন পর্যন্ত আশঙ্কা করা হচ্ছে, মহামারির প্রভাব খুব ভয়াবহ হতে চলেছে বাংলাদেশের জন্য। দ্য ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ধারণা করছে, এ বছর বাংলাদেশের জিডিপি ৪ শতাংশ কমে যেতে পারে। বাংলাদেশ সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা অসাধারণ। কিন্তু এখনো এটি কতখানি কার্যকর হবে তা নিশ্চিত হতে অপেক্ষা করতে হবে।
(আনন্দ কুমার একজন নয়া দিল্লি ভিত্তিক বিশ্লেষক)