তবু কেতন উড়িয়ে এলো বৈশাখ

0

মহিউদ্দীন মোহাম্মদ ॥ এলো নতুন বছর, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। জীর্ণ পুরাতন সবকিছু পেছনে ফেলে নতুনের কেতন উড়িয়ে দুয়ারে এসেছে বৈশাখ। বৈশাখ এসেছে আশা ও দুরাশার দোলাচালে। তাই প্রত্যেকে নিজের ঘরে থেকে স্বাগত জানাবে ব্যতিক্রমী নতুন বছরকে । তীব্রবাসনাকে নির্বাপিত করে জাগবে জাতি। ফি বছরের রঙিন উৎসবের মত হবে না সমাগম। তবু শুভ নববর্ষ! যদিও গতকালের খবর ছিল, করোনার হানায় দেশে আরও ১৮২ জন আক্রান্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮০৩। জনজীবনের কোলাহল- তাই তছনছ হয়ে গেছে। নতুন বছরে আশা সবার- অতিদ্রুত যেন কেটে যায় করোনার মেঘ।
বিশ্বে বিপন্ন মানবতা।
করোনার হানায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ মরছে। ঘরে আটকে থেকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ। খেটে খাওয়া মজুরের চোখে-মুখে শর্ষেফুল। অন্ন জোগাড়ই হয়ে পড়েছে তাই বড্ড কঠিন। অনাহারী জীবনের শঙ্কায় উবে গেছে উৎসব। সব মিলিয়ে ভালো নেই জাতি। যদিও সরকার শোনাচ্ছেন গভীর আশারবাণী। আমরাও বুক বেধে থাকি সেই আশায়। সাড়া দিই নিত্য আহ্বানে। এখন কৃষ্ণপ। কঠিন পরীার দিন। আসুন তাই এই নতুন বছরের শুরুতেই সংগ্রামের ইচ্ছেই ঐক্যবদ্ধ হই, স্বপ্ন দেখি সুন্দর আগামীর। আশার জয়গানে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি-উই শ্যাল ওভার কাম…আমরা করব জয় একদিন।
এদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রী ফলাহারের মধ্যদিয়ে উদযাপন করতে বলেছেন নতুন বছরকে। তিনি অনুরোধ করেছেন কাঁচা আম, জাম, পেয়ারা, তরমুজ-সহ নানা মওসুমি ফল সংগ্রহ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়িতে বসেই নববর্ষেও আনন্দ উপভোগ করার। বিনা কারণে ঘরের বাইরে যেতে বারণ করেছেন। অযথা কোথাও ভিড় করতে নিষেধ করেছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেকে ও পরিবারের সদস্যদের রার তাগাদা দিয়েছেন।
পহেলা বৈশাখ বাঙালীর আনন্দের দিন, উৎসবের দিন। সকল জড়তা, জীর্ণতা, ব্যর্থতাকে বিসর্জন দিয়ে নতুন সম্ভাবনাময়, আশা-প্রত্যাশায় অবগাহনের দিন। চৈত্রের শেষদিনেও বাঙালীর মন থাকে হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, সাফল্য-ব্যর্থতায় জড়ানো, স্মৃতিভরা পুরনো বছরে। রুদ্র বৈশাখের তাপস-বায়ে বিগত দিনের সকল কেদ-গ্লানি উড়িয়ে দিয়ে বাঙালীর জীবনে নিয়ে আসে নবীন জীবনের আশ্বাস। পহেলা বৈশাখে স্বাগত জানায় সে আশ্বাসকে। আনন্দে-উৎসবে বরণ করে নেয় শুভ নববর্ষকে। পহেলা বৈশাখ বাংলার দিন, বাঙালীর দিন। পহেলা বৈশাখের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর সর্বজনীনতা। ধর্মের ভেদ, বর্ণের পার্থক্য, বিত্ত-বৈভবের ফারাক সব ভুলিয়ে সকল বাঙালিকে পহেলা বৈশাখ এক কাতারে সামিল করে। পহেলা বৈশাখের সকল উৎসব, সকল আয়োজনে বাঙালি মাত্রই সমান অংশীদার। মূলত বাংলা সাল একমাত্র বাঙালিরই। নববর্ষে নজরুল ইসলাম ঘোষণা করেছেন নতুনের মহত্তম আহবান-‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল বৈশাখীর ঝড়,/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’ ফররুখ আহমদ নববর্ষকে দাওয়াত জানিয়েছেন এইভাবে-‘ধ্বংসের নকীব তুমি হে দুর্বার, দুর্ধর্ষ বৈশাখ/ সময়ের বালুচরে তোমার কঠোর কণ্ঠে/শুনি আজ অকুণ্ঠিত প্রলয়ের ডাক/ চৈত্রের বিশীর্ণ পাতা রেখে গেছে শেষ চিহ্ন সাল তামামীর,/ফাল্গুনের ফুল দল ( কোকাফের পরী যেন) আজ শুধু/কাহিনী স্মৃতির…’বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালিরা পালন করে নববর্ষ। চৈত্রসংক্রান্তি থেকেই নতুন বছরকে বরণ করার নানা আয়োজনে ব্যস্ত থাকে বাংলাদেশের ুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলোও। জীর্ণ মলিনকে পেছনে ফেলে নতুনকে বরণ করে নেওয়ার দিন, হালখাতা খোলার দিনও ভাবা হয় পহেলা বৈশাখকে।পহেলা বৈশাখ ও নববর্ষ বাঙালির বিজয় পতাকা আকাশে তুলে ধরে। পাকিস্তানি শাসনামলে নববর্ষ উদ্যাপনকে ‘হিন্দুয়ানি’ বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তারই প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালে ছায়ানট রমনার বটমূলে বর্ষবরণ উৎসবের আয়োজন করে। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচু উপো করে হাজার হাজার বাঙালি সেদিন যোগ দিয়েছিল এ উৎসবে। সেই থেকে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ছায়ানটের এ উৎসবটি বাঙালির সর্বজনীন এক উৎসবে পরিণত হয়। পহেলা বৈশাখের আরেক আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রা। তবে এসব থাকছে না এবার।