সাবানে কি ভাইরাস মরে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার কতোটা কার্যকর

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ করোনাভাইরাস আতঙ্কে হঠাৎ করে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও জেলের কদর বেড়ে গেছে। সবাই মনে করছে, সুন্দর বোতলে ভরা এই নীল তরলটিই ভাইরাস থেকে রক্ষা করবে। ফলে করোনা প্রাদুর্ভাবের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার একদিনের মাথায় সব কোম্পানির হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। অনেকে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে। আর এখন তো হারিকেন দিয়ে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে শেষ পর্যন্ত সরকার দাম বেঁধে দিলেও তাতে খুব একটা লাভ হয়নি।
কিন্তু হ্যান্ড স্যানিটাইজার কি আসলেই ভাইরাস নিধনে কার্যকর। তাছাড়া এটি ত্বকের জন্য কতোটা নিরাপদ। সাধারণ সাবান পানি কি যথেষ্ট নয়? এ বিতর্ক চলছে বিশ্বজুড়েই। বিষয়টি খোলাসা করতেই বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য শোনার আগে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের আবিষ্কার নিয়ে দুটো কথা বলা যাক। এটি সেই অর্থে নতুন কোনো জীবাণুনাশক নয়। ১৯৬৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার বেকার্সফিল্ডে নার্সিংয়ের শিক্ষার্থী লুপে হার্নান্দেস হাত ধোয়ার অ্যালকোহলভিত্তিক একটি জেলের পেটেন্ট করেন। হাত ধোয়ার ব্যবস্থা নেই এমন স্থানে এটি ব্যবহার করাই ছিল উদ্দেশ্য। তবে ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু (এইচ১এন১ ভাইরাস) প্রাদুর্ভাবের আগে পর্যন্ত এটি সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। ওই বছর মাত্র ছয় মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাকটেরিয়ানাশক জেল বা তরল বিক্রি ৭০ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়। ২০১০ সালে এ ধরনের জীবাণুনাশকের ছোট ছোট শিশি বিমানবন্দর থেকে বইয়ের দোকান সবখানে সয়লাব হয়ে যায়। পকেটে বা ব্যাগে বহন করা যায় এমন আকার আকৃতির শিশিতে ভরে দেদার বিক্রি শুরু হয় অনলাইনেও।
তবে শুধু যে মহামারির ভীতি থেকেই হ্যান্ড জেলের জনপ্রিয়তা বেড়েছে এমনটা নয়। এখানে ভূমিকা রেখেছে বিভিন্ন কোম্পানির বিপণন কৌশলও। বর্তমানে আকর্ষণীয় ও শিশুবান্ধব রঙ (হালকা গোলাপী, উজ্জ্বল নীল) আর সুন্দর কোমল ঘ্রাণ (দারুচিনি, ল্যাভেন্ডার) বিশিষ্ট জীবাণুনাশক প্রায় সবখানেই পাওয়া যায়। যেখানে একই উপাদানে তৈরি জীবাণুনাশক দেখা যায় হাসপাতালে, কিন্তু সেগুলোর গন্ধ খুব তীব্র।
জীবাণুনাশকে অ্যালকোহলের স্থলে অন্য নানা উপাদানও প্রতিস্থাপিত হয়েছে। অনলাইনে এমন অনেক রেসিপি পাওয়া যায়। এমনকি অনেকে ভোদকা ব্যবহারের পরামর্শও দেয়! অ্যালোভেরার কথাও বলা হয়। কিন্তু আসলেই কি এগুলো জীবাণু ধ্বংসে কার্যকর!
স্বাস্থ্যবিধি বিশেষজ্ঞ, যুক্তরাজ্যে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা ও জনস্বাস্থ্য বিভাগ একটা বিষয়ে একমত যে, ভাইরাস নিধন করতে চাইলে সেই জীবাণুনাশকে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ অ্যালকোহল থাকতে হবে। বাজারে প্রাপ্ত হ্যান্ড হ্যানিটাইজারগুলোতে সাধারণত ৬০-৯৫ শতাংশ থাকে। তবে যাদের ত্বক অত্যন্ত সংবেদনশীল তাদের জন্য অ্যালকোহলের বদলে অন্য উপাদানে তৈরি জীবাণুনাশকও রয়েছে। ব্যাকটেরিয়ানাশক আরেকটি কার্যকর এজেন্ট হিসেবে ট্রাইক্লোসান প্রায় এক দশক ধরে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এর ভয়ানক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ এটি নিষিদ্ধ করে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন বিভাগ।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক স্যালি ব্লুমফিল্ড বলেন, জীবাণুনাশকের বিরুদ্ধে ভাইরাসের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তবে সৌভাগ্যক্রমে করোনাভাইরাস একটি এনভেলপ ভাইরাস। অর্থাৎ এর বাইরে একটি আবরণ রয়েছে যেটি অ্যালকোহলের সংস্পর্শে নষ্ট হয়। নরোভাইরাস বা রাইনোভাইরাস কিন্তু এমন নয়।
তবে ঘরে তৈরি জীবাণুনাশকের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন স্যালি। তিনি বলেন, এ ধরনের জীবাণুনাশক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসে কার্যকর হতে পারে ঠিকই কিন্তু এটি বিপজ্জনক হতে পারে। বাজারে যেসব জীবাণুনাশক পাওয়া যায় সেগুলোর কিছুতে এমন উপাদান থাকে যা সেটিকে ত্বকের জন্য সহনীয় করে তোলে। উপাদানগুলো নির্দিষ্ট অনুপাতে মেশাতে না পারলে বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সুতরাং ঘরে বানানো জীবাণুনাশক ব্যবহার না করাই ভালো।
এখন আসল কথা হলো, হ্যান্ড স্যানিটাইজার কখন ব্যবহার করতে হবে। কভিড ১৯ কীভাবে ছড়ায় সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে অন্যান্য ফ্লু ভাইরাসের মতো এটি হাঁচি, কাশি, লালা ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়ায় বলে অনুমান করা হচ্ছে। আবার অন্যান্য নির্জীব বস্তুর সঙ্গে এটি লেগে থাকতে পারে। এ কারণে নিরাপদ থাকার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, বাইরে থেকে বাসা বা অফিসে প্রবেশের পর সাবান পানি দিয়ে ভালো করে কবজি পর্যন্ত হাত ধুয়ে ফেলা। আর সাবান না পেলে হ্যান্ড স্যাটিনটাইজার। লিফটের বার, বাসের হ্যান্ডল বা পোল, সিঁড়ির রেলিং, চলন্ত সিঁড়ির বেল্ট এসব স্থানে হাত না দেয়াই ভালো। হাত দিতে বাধ্য হলে যতো দ্রুত সম্ভব হাত ধুলে ফেলা বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে।
যে কোনো ভাইরাসের বংশবিস্তারের জন্য পোষক হিসেবে সজিব কোষের দরকার হয়। এ কারণে জীবাণুমুক্ত না করে হাত নাকে, মুখে বা চোখে দেয়া যাবে না। যতোটা পারা যায় হাত দিয়ে এটা ওটা ধরা এড়িয়ে চলতে হবে।
হাত জীবাণুমুক্ত করার সবচেয়ে ভালো ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকিমুক্ত জিনিস হলো সাবান পানি। আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইকোবায়োলজির ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়, প্রবাহিত পানি (ট্যাপ) ও সাবান দিয়ে হাত ধোয়া জেল ব্যবহারের চাইতে ভালো। কারণ জেল দিয়ে হাত ভালোভাবে ঘষা যায় না।
সাবানের মৃদু ব্যাকটেরিয়ানাশক বৈশিষ্ট্য থাকলেও ভাইরাস ধ্বংস করার জন্য কিন্তু যথেষ্ট নয়। সাবান মূলত ময়লা পরিষ্কারক। সুতরাং হাত ভিজিয়ে ভালো করে সাবান লাগিয়ে নিতে হবে। হাতের দুই পিঠ, আঙ্গুলের ফাঁক এবং নখের নিচে সাবান পৌঁছাচ্ছে কিনা খেয়াল করুন। এরপর দুই হাত ভালোভাবে ঘষে কবজি পর্যন্ত ফেনা তুলে সাবান মাখাতে হবে। এবার পানির নিচে ২০ মিনিট ধরে ধুতে হবে। হাতের জীবাণু ধ্বংসে এটিই সর্বোত্তম পদ্ধতি। কারণ সাবান লাগিয়ে হাত ধুলে ময়লার সঙ্গে ভাইরাসও ধুয়ে যায়। হাত ধোয়ার পর ডিসপোজেবল টাওয়েল দিয়ে হাত মুছে শুকিয়ে ফেলার পর টাওয়েলটি দিয়ে ধরে ট্যাপ বন্ধ করতে হবে। এর পর সেটি ডাস্টবিনে ফেলতে হবে।
২০১২ সালে চিকিৎসা সাময়িকী মায়ো ক্লিনিক প্রসিডিংসে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্যবিধির দিক থেকে গরম বাতাসে হাত শুকানোর চাইতে কাগজের টাওয়েলে হাত মোছা ভালো। কারণ টাওয়েল দ্রুত এবং পুরো হাত শুকিয়ে ফেলতে পারে। ভেজা হাতে জীবাণু দূষণ বেশি হয়।
পরিবেশ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লিসা অ্যাকারলি বলেন, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মজুদ সাধারণত কমই থাকে। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে প্যানিক বায়িং। এর দরকার নেই। কারণ এ ধরনের জীবাণুনাশক খুব বেশি লাগে না। এক শিশিতে অনেক দিন চলে যায়। আর যেখানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা নেই তখনই শুধু এটি ব্যবহার করা উচিত।
রাসায়নিক কোম্পানি কাও করপোরেশনের একজন মুখপাত্র বলেন, অতিরিক্ত হ্যান্ড জেল ব্যবহার করলে ত্বক শুকিয়ে এবং প্রাকৃতিক তেল মুছে গিয়ে ত্বক সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে এবং জ্বালাপোড়া হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত ত্বকে সংক্রমণে ঝুঁকি বেশি থাকে। ফলে বেশি বেশি হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করলে আরো বিপদ ডেকে আনতে পারে।
অধ্যাপক ব্লুমফিল্ড বলছেন, এতোকিছু ভাবার দরকার নেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সবার উচিত সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। বিশেষ করে হাত পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতি একটু বেশি নজর দিতে হবে।