বেতন-ফির উচ্চহার কেজি স্কুলে # শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য-৪

0

মোস্তফা রুহুল কুদ্দুস ॥ কোমলমতি শিশুদের গড়ে তুলতে কিছু কিন্ডারগার্টেন (কেজি স্কুল) ভালো ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এর পাশাপাশি আরেকটি চিত্র রয়েছে। অনেক স্কুলেই শিক্ষার গুণগত মান, লেখাপড়ার পরিবেশ ও যোগ্য শিক্ষক নেই। এমনকি অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তিরাও গড়ে তুলেছেন প্রতিষ্ঠান। সেখানে উচ্চহারে বেতন ফি নেয়া হলেও শিক্ষকদের দেয়া হয় না পারিশ্রমিক। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটের মতোই এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে বাণিজ্যিক সুবিধা নেয়া হচ্ছে।
দেশে ক্রমবৃদ্ধিহারে বেড়ে চলেছে জনসংখ্যা। বাড়ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু সে তুলনায় সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠেনি মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সুবিধাবাদীরা এ সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে। তারা পাড়া মহল্লার অখ্যাত খিঞ্জি পরিবেশে বাড়ি ভাড়া নিয়ে গড়ে তুলেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নাম দিচ্ছে ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল, ক্যাডেট, প্রি-ক্যাডেট টাইপের চটকদার ভাষায়। কিন্তু নামের সাথে বাস্তবের কোন মিল থাকছে না। কম টাকায় কম শিক্ষিত অযোগ্য অথর্ব লোক নিয়ে চালানো হচ্ছে প্রতিষ্ঠান। এভাবে পুঁজি বিনিয়োগ করে বাণিজ্যিক ফায়দা লুটছে কিছুু বেকার যুবক ও সুবিধাবাদীরা। মুনাফার কারণে একই জায়গায় একই পরিবারের সদস্য ও শিক্ষকরা পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন।
এক যুগ আগে ‘মানিক স্যার’ নামে এক ব্যক্তি বারান্দীপাড়ায় জেস রেসিডেন্সিয়াল প্রি-ক্যাডেট নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বর্তমানে বুধো নামে পরি চিত স্বল্প লিখিত ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধর। সেই নামের সাথে ‘নিউ’ যোগ করে গড়ে উঠেছে আরেকটি প্রতিষ্ঠান। পারিবারিক দিক দিয়ে দুই মালিকই কাছাকাছি। কিন্তু তাদের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান ও ভালো পরিবেশ নেই।
হামিদপুর ময়লাখানার পাশে সততা প্রি-ক্যাডেট নামে কেজি স্কুল খুলে বসেছেন দেবব্রত অধিকারী। তার স্ত্রী এর পরিচালক। শিক্ষিত জাতি গড়ে তোলার শ্লোগান দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালালেও তাদের নিজেদেরই কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। অবশ্য দেবব্রত অধিকারী বলেছেন, তারা কম শিক্ষিত হলেও শিক্ষকরা যোগ্য ও শিক্ষিত।
টাঙ্গাইল থেকে যশোর শহরে পরিচালিত হচ্ছে দুই ভাই’র দুই স্কুল। মূল নামের আগে নিজেদের নাম জুড়ে দিয়ে এর নাম রাখা হয়েছে শাহীন স্কুল এন্ড ক্যাডেট একাডেমি এবং শহীদ স্কুল এন্ড ক্যাডেট একাডেমি। প্রতিষ্ঠানে নিজেদের প্রকাশনীর বই-খাতা, কলম, ব্যাগ ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা হয়। লেখাপড়ার মান ভাল হওয়ায় ভর্তি, বেতন ফি সেশন চার্জ অনেক বেশি। এ থেকে আয়ের পাশাপাশি তারা নিজস্ব উপকরণ বিক্রি করে উপার্জনের বহুমুখি পথ আবিস্কার করেছেন। দু’জনের পৃথক পৃথকভাবে এমন স্কুল রয়েছে অর্ধশতাধিক। এর আয় নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়ায় তারা একই স্থানে পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। এতো আয় উপার্জনের পরও তারা শিক্ষক-কর্মচারীদের নামমাত্র পারিশ্রমিক দেন। ফলে শিক্ষকরা বেশি দিন টেকে না। শাহীন স্কুল দু’মাসে দুবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রায় তিনশ’ আবেদনকারী পায়। কিন্তু কম বেতনের কারণে নিয়োগ চূড়ান্ত করতে পারেনি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রত্যেকটি কেজি স্কুল শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন নামে মোটা অংকের ফি আদায় করে। কিন্তু শিক্ষকদের বেতন দেয় ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা।
বাণিজ্যিক দৃষ্টিতেই যশোর শহরের যত্রতত্র গড়ে উঠছে কেজি স্কুল। ঝুমঝুমপুর এবং শেখহাটি ব্রিজের কাছে মাত্র ৩০/৩৫ গজ ব্যবধানে গড়ে উঠেছে দুটি করে চারটি স্কুল। এর মধ্যে একটির নাম ন্যাশনাল ক্যাডেট স্কুল। আরেকটির নাম ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। নামের সাথে রয়েছে গুণ মান ও পরিবেশের আকাশ-পাতাল ব্যবধান। কেজি স্কুল এভাবেই শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করে চলেছে। এ প্রসঙ্গে আইডিয়াল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মিজানুল ইসলাম মোল্লা বলেন, বাণিজ্য থাকা দোষনীয় নয় বরং যে প্রতিষ্ঠানের পেছনে বাণিজ্য বা মুনাফা নেই তা সততার সাথে টিকে থাকতে পারে না। বাণিজ্যের সাথে যে জিনিসটি থাকা অনিবার্য, তা হচ্ছে ভালো পণ্য। বেশি দামে ভালো পণ্য দিলে ক্রেতাদের আপত্তি থাকে না। যশোর শহরের অনেক ব্যয়বহুল স্কুল ভালো রেজাল্ট করছে। অভিভাবকরা আপত্তি না করে সে সব স্কুল সহজে গ্রহণ করছে। এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা।
বীরশ্রষ্ঠ নূর মোহাম্মদ ন্যাশনাল ক্যাডেট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল বলেন, শিক্ষা বিস্তারে কোন ভূমিকা না রেখে যারা বাণিজ্য করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।