সড়কে মর্মান্তিক মৃত্যু বাড়ছে

0

সংবাদপত্রে শিরোনাম হবার জন্য খবরের অভাব নেই। তারপরও শীর্ষ শিরোনাম হচ্ছে সড়কে মৃত্যুর মিছিল। দেশে প্রতিদিনই মর্মান্তিক সব সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে এবং পরদিন পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হচ্ছে। গত শুক্রবার রাতে যশোরে একটি প্রাইভেটকার রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা লাগায় এক পরিবারের তিন মহিলা নিহত হয়েছে, যাদের দু’জন আপন বোন ও অন্যজন তাদের ভাবি সম্পর্কিত। দুই বোনের একজনের ২৩ জানুয়ারি স্বামীর ঘরে তুলে দেয়ার কথা ছিল। এই দুর্ঘটনায় শিশুসহ আরো চারজন আহত হয়েছে। একই রাতে যশোর-সাতীরা সড়কে নছিমনের চাপায় নিহত হয়েছে একশিশু। সিলেটের টিলাগড়ে শুক্রবার রাতেই এমসি কলেজের দুই ছাত্র রাস্তার পাশের দেয়ালে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় নিহত হয়েছে। আরো দুইজন আহত হয়েছে। ওই রাতে সিলেটের দণি সুরমায় অটোরিকশা ও লেগুনার সংঘর্ষে অটোরিকশার এক মহিলা যাত্রী নিহত হয়েছে এবং তার দু’ সন্তান আহত হয়েছে। পঞ্চগড়-বাংলাবাদ্ধা সড়কে ট্রাকের ধাক্কায় নিহত হয়েছে এক মোটরসাইকেল আরোহী। শনিবার সকালে গোপালগঞ্জ-টেকের হাট সড়কে গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কায় দুই যাত্রী নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছে। দুপুরে রাজশাহীর বাগমারায় অটোরিকশার ধাক্কায় নিহত হয়েছে এক মহিলা। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে ঝিনাইদহে যানচাপায় এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়। রাত পেরোলেই তার বিয়ের কথা ছিল। ঝিনাইদহেরই কালীগঞ্জ উপজেলায় আলমসাধুুর ধাক্কায় দাদার কাঁধ থেকে পড়ে গিয়ে শিশু নাতি নিহত হয়। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাস-মিনিবাসের সংঘর্ষে স্বামী-স্ত্রীসহ তিনজন নিহত হয়। দম্পতির একমাত্র শিশু সন্তান ভাগ্যগুণে বেঁচে যায়। ছোট ভাইয়ের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে মোটরসাইকেলে দু’ভাই গাজীপুর থেকে বেরিয়ে উত্তরায় এসে বাসচাপায় লাশে পরিণত হয়। যাত্রাবাড়িতে রাতে রাস্তা পার হওয়ার সময় নিহত হয় দুইজন, তারা সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শিবপুরে বাস ও প্রাইভেটকারের সংঘর্ষে প্রাইভেটকারের চালক নিহত ও ৩৫জন আহত হয়।
মাত্র তিনদিনের সড়ক দুর্ঘটনার একটি অসম্পূর্ণ তথ্য-পরিসংখ্যানে এখানে উল্লেখ করা হলো। অসম্পূর্ণ এজন্য যে, সড়ক দুর্ঘটনার সব তথ্য পুলিশের রেকর্ডে আসেনা এবং সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয় না। অনেক তথ্যই অজানা থেকে যায়। আমাদের সড়ক-মহাসড়কে প্রতিদিন কত যে ট্রাজেডির জন্ম হচ্ছে, তিনদিনের ঘটনাবলী থেকেই তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়। প্রতিদিনই মানুষ হতাহত হচ্ছে এবং তাদের স্বপ্ন-প্রত্যাশা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তাদের পরিবার-পরিজন অসহায়ত্তের মধ্যে পতিত হচ্ছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে গত বছর ৭ হাজার ৮০০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১৩ হাজার ৩৩০জন। এই সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ৮ দশমিক শূণ্য ৭ শতাংশ বেশি। প্রতিবছরই সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছর গেল বছরের চেয়ে যে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়বে, প্রথম মাসের আলামত থেকে, সেটা বুঝা যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান-অপ্রধান কারণগুলো কারো অজানা নেই। কীভাবে এই দুর্ঘটনা কমানো যায়, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের সুনির্দিষ্ট সুপরিশও সবার জানা। তারপরও সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভবপর হচ্ছে না কেন, প্রতিবছরই তা বাড়ছে কেন, সেটাই প্রশ্ন। আমরা শুরুতে তিনদিনের সড়ক দুর্ঘটনার যে তথ্য-পরিসংখ্যান উল্লেখ করেছি, তা গভীরভাবে পর্যালোচনায় নিলেই কারণটি স্পষ্ট হযে যাবে। সর্বত্রই বিশৃংখলা দৃশ্যমান। সড়ক-মহাসড়কে শৃংখলা নেই। দ্রুতগতি, মধ্যগতি ও ধীরগতির যানবাহন একই সঙ্গে চলছে। বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকারের সঙ্গে থ্রিহুইলার এবং আলমসাধু, নছিমন-করিমন সবই চলছে। মহাসড়কে থ্রিহুইলার, আলমসাধু, নছিমন-করিমন চলাচলের ব্যাপারে আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে। এ নিষেধাজ্ঞা মানা হচ্ছে না। মানানোর কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। ইচ্ছামত সড়ক দখল করে চলা, প্রতিযোগিতা করা ও ওভারটেকিং অতি সাধারণ ঘটনা। বাস-ট্রাকের চালকরা সড়কে যেমন বেপরোয়া তেমনি যাত্রী-পথচারীরাও। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ বেপরোয়া গাড়ি চলনা এবং এ জন্য চালকরাই দায়ী। এক প্রতিবেদন মতে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ নিহত হয়েছে তাদের অর্ধেক পথচারী। তারা গাড়িচাপা, পেছন থেকে ধাক্কা ও রাস্তা পারাপারের সময় নিহত হয়েছে। একই প্রতিবেদনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে কয়েকশ চালক বা আরোহী নিহত হয়েছে। আধাদ-অদ চালক, অপরিনামদর্শী যাত্রী ও পথচারী এবং মোটরসাইকেলের অসতর্ক চালক যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বিশেষভাবে দায়ী সুতরাং এদের দিকে অধিকতর নজর দিতে হবে। দ-অভিজ্ঞ চালক নিয়োগ, যাত্রী-পথচারীদের মধ্যে যথযথ সচেতনতা এবং মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে সতর্কতা নিশ্চিত করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। আমরা মনে করি আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম চালানো উচিৎ।