খাদ্যাভ্যাসে চাপ পড়ছে বাজার ভারসাম্যে?

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ নদী অববাহিকা অঞ্চল ও ধানকেন্দ্রিক কৃষি উৎপাদনের কারণে ঐতিহাসিকভাবে ভাতের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের মানুষ। কালের বিবর্তনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কৃষি উৎপাদনে বৈচিত্র্য এলেও মানুষের খাদ্যাভ্যাসে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। এখনো আগের মতোই ভাতের ওপর নির্ভরশীলতা রয়ে গেছে। ফলে প্রচুর ধান উৎপাদনের পরও চাল আমদানি করতে হয়। যদিও ভোগ কম হওয়ায় প্রতি বছর নষ্ট হয় প্রচুর আলু। অন্যদিকে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও অতিরিক্ত চাহিদার কারণে বেড়ে চলেছে পেঁয়াজসহ মসলাপণ্য আমদানি। মূলত খাদ্যাভ্যাসের কারণেই দেশে প্রাপ্যতা রয়েছে এমন খাদ্যপণ্যের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে না। আবার কিছু পণ্যে বাড়ছে আমদানিনির্ভরতা, যা ভারসাম্যহীন করে তুলছে ভোগ্যপণ্যের বাজারকে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিটের (এফপিএমইউ) ‘মনিটরিং রিপোর্ট-২০১৯ অব দ্য বাংলাদেশ সেকেন্ড কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দৈনিক মাথাপিছু দানাদার খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ৪০৯ গ্রাম। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, পুষ্টিসমৃদ্ধ আদর্শ খাদ্যতালিকায় একজন মানুষের দৈনিক ৪০০ গ্রাম দানাদার খাদ্য থাকলেই চলে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভাত গ্রহণের ফলে এখনো চাল আমদানি করতে হয়।
আদর্শ খাদ্যতালিকার অন্যতম অনুষঙ্গ আলু। একজন মানুষের দৈনিক ১০০ গ্রাম আলু গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। যদিও দেশে মাথাপিছু আলু গ্রহণের পরিমাণ ৬৫ গ্রাম। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদন হয় ৯৭ লাখ ২৫ হাজার টন, যা চাহিদার তুলনায় প্রায় ৩০ লাখ টন বেশি ছিল। মূলত প্রয়োজনের তুলনায় কম ভোগের কারণে দেশে উৎপাদিত প্রচুর আলু নষ্ট হচ্ছে। ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক।
স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও খাবারে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি মসলা ব্যবহার করা হয়। মাথাপিছু দৈনিক মসলার কাঙ্ক্ষিত মাত্রা ২০ গ্রাম, প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ৭৫ গ্রাম। দেশে উৎপাদিত মসলা এ চাহিদা পূরণ করতে না পারায় আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছে। চলমান পেঁয়াজ সংকটের মূলেও রয়েছে আমদানিনির্ভরতা।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, অর্থনীতির রূপান্তরের সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন ঘটছে। কৃষিনির্ভর সমাজে কায়িক পরিশ্রম বেশি ছিল। সে সময়ের খাদ্যতালিকার সঙ্গে এখনকার খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন এসেছে। এক্ষেত্রে পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবার গ্রহণের বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। অস্বাস্থ্যকর হলেও বিশ্বের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে বেশি মসলা ব্যবহার করছি আমরা। এজন্য আমাদের নির্ভর করতে হয় আমদানির ওপর। পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে এগুলোর ওপর চাপ কমে আসবে। এজন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সচেতনতা প্রয়োজন।
প্রয়োজনের তুলনায় কম ভোগ হচ্ছে সবজিও। আদর্শ খাদ্যতালিকা অনুযায়ী, মাথাপিছু দৈনিক সবজি গ্রহণের কাঙ্ক্ষিত মাত্রা ৩০০ গ্রাম হলেও প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ১৬৭ গ্রাম। যদিও দেশে এখন প্রায় ১২ মাসই সবজি উৎপাদন হয়। বিশেষ করে শীত মৌসুমে সবজি উৎপাদন চাহিদা ছাড়িয়ে যায়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শীত ও গ্রীষ্মকালীন সবজি উৎপাদন ছিল ৪১ লাখ ২১ হাজার টন।
খাদ্যতালিকায় যে জিনিসটির ঘাটতি সবচেয়ে বেশি তা হচ্ছে ফলমূল। পুষ্টি চাহিদা পূরণে একজন মানুষের দৈনিক ১০০ গ্রাম ফল খেতে হয়। কিন্তু দেশে মাথাপিছু ফল গ্রহণের পরিমাণ মাত্র ৩৬ গ্রাম। বর্তমানে আম উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম ও পেয়ারায় অষ্টম। এছাড়া দেশে প্রচুর কাঁঠাল উৎপাদন হয়। খেতে অনেকের অনীহা থাকায় প্রতি বছর নষ্ট হয় অনেক পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ এ ফল।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, আমরা ফলমূল কম খাচ্ছি। ফলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাচ্ছে, থাকছে পুষ্টি ঘাটতি। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় শাকসবজি নিশ্চিত করা গেলে পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রোগ-ব্যাধিও শরীরে বাসা বাঁধতে পারবে না।
প্রয়োজনের তুলনায় কম ভোগ হচ্ছে ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি-গুড় ও প্রাণিজ উৎসের খাদ্যও। আদর্শ খাদ্যতালিকা অনুযায়ী, মাথাপিছু দৈনিক ডাল গ্রহণের কাঙ্ক্ষিত মাত্রা ৫০ গ্রাম হলেও প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ১৬ গ্রাম। মাথাপিছু ভোজ্যতেল প্রয়োজন ৩০ গ্রাম, প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ২৮ গ্রাম। প্রাণিজ উৎসের খাদ্য প্রয়োজন ২৬০ গ্রাম, প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ১২৯ গ্রাম। মাথাপিছু চিনি-গুড়ের প্রয়োজন ২০ গ্রাম হলেও প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ মাত্র সাত গ্রাম।
ডব্লিউএইচওর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, খাবারে বৈচিত্র্যের উপস্থিতি কম ও পুষ্টিকর পরিপূরক খাবারের অপর্যাপ্ততাকে দুর্বল ইনফ্যান্ট অ্যান্ড ইয়াং চাইল্ড ফিডিং (আইওয়াইসিএফ) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এটিকে শিশুর খর্বাকৃতির প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৪টি উপকরণ নিয়ে প্রতিদিনের একটি খাদ্যতালিকা রয়েছে। উন্নত দেশে এটি ১৮-২০ ধরনের হতে পারে। সেখান থেকে প্রতিদিন পাঁচটি উপকরণ দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় থাকা প্রয়োজন। তবে আর্থিক সামর্থ্যের বিচারে অনেকেরই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকে সেটি। আবার এ বিষয়ে সচেতনতারও অভাব রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বলেন, দেশের মানুষের উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হলেও প্রাণিজ প্রোটিনের ঘাটতি আছে। আবার ফ্যাটযুক্ত খাবার যাদের প্রয়োজন, তারা খেতে পারছে না। যাদের প্রয়োজন নেই, তারা অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খাচ্ছে। পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে এমন অনেক অসংগতি রয়েছে।
তিনি বলেন, অতিরিক্ত যেকোনো খাবারই শরীরের জন্য খারাপ। পুষ্টিকর খাবারও বেশি পরিমাণে খেলে সেটা সমস্যার কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার গ্রহণ না করাই ভালো। স্থূলতা, হূদরোগ, গ্যাস্ট্রিক আলসার ও ক্যান্সারের মতো রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস অনেকাংশেই দায়ী।