ইরান আপস করবে বলে মনে হয় না

0

গোলাম মাওলা রনি
জেনারেল কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের আগে তার সম্পর্কে আমাদের দেশের আমজনতা খুব কমই জানতেন। মাস কয়েক আগে তার ব্যাপারে বিস্তারিত জেনেছি। যখন প্রভাবশালী পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো ইরানের আল কুদস বাহিনীর প্রধান সোলাইমানিকে বর্তমান জমানার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জেনারেলের খেতাব দিলো, তখন জেনারেল সোলাইমানির বীরত্বগাথা জানার জন্য উঠেপড়ে লাগলাম। তার কয়েকটি স্টিল ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ দেখলাম এবং সেগুলোর সাথে তার কর্মকাণ্ডকে মেলানোর চেষ্টা করলাম। তখন তার উজ্জ্বলতম চোখের দ্যুতি এক মমত্ববোধের পয়গাম নিয়ে আমার অন্তরে প্রবেশ করল। মধ্যপ্রাচ্যের অশান্ত রাজনীতি- যুদ্ধ, পশ্চিমা যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রগুলোর অপতৎপরতা এবং মুসলমানদের রাষ্ট্রগুলোতে বিশালাকার সেনাঘাঁটি গড়ে তোলা এবং মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলো যেসব সাগর উপকূলে অবস্থিত, সেইসব সাগরে পশ্চিমা রণতরীগুলোর মহড়া আমার মতো গোবেচারাকেও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ফলে যখন জানলাম যে, জেনারেল সোলাইমানি গত ৪০ বছর ধরে পশ্চিমা অপশক্তির বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করে যাচ্ছেন, তখন তার সম্পর্কে এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়ে গেল।
হজরত উমর রা:-এর জমানায় মুসলমান সাম্রাজ্য হেজাজ, নজদ ও ইয়েমেন অতিক্রম করে সিরিয়া, মিসর, পারস্য বা ইরান, ফিলিস্তিন বা জেরুসালেমসহ সাইপ্রাসে বিস্তৃতি লাভ করে। নতুন এই বিশাল সাম্রাজ্যে যে রাজনৈতিক জটিলতা দেখা দেয়, সে কারণেই হজরত উসমান রা:-এর জমানায় মিসরে এবং অন্যান্য এলাকায় বিরোধ দেখা দেয়। সিরিয়া, লেবানন, সাইপ্রাস খুব প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। ফলে ইরাক ও ইরানে দেখা দেয় নিদারুণ অসন্তোষ। এই রাজনৈতিক অসন্তোষকে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর জন্য খারেজি গুপ্তহত্যাকারী গ্রুপের মতো সংগঠন গড়ে ওঠে। চতুর্থ খলিফা আলী রা:-এর জমানায় জঙ্গে জামাল বা উষ্ট্র্রীর যুদ্ধ, সিফফিনের যুদ্ধসহ আরো কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কারণে প্রায় এক লাখ যোদ্ধা নিহত হন, যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন নামকরা সাহাবি। এসব যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ পরিবার বাস্তুচ্যুত হন, জাতীয় অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং নব্য মুসলিম সাম্রাজ্যের বর্তমান ও সাবেক শত্রুরা খিলাফতকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। বিশেষ করে কনস্টান্টিনোপল-কেন্দ্রিক পূর্ব রোম সাম্রাজ্য এবং রোম-কেন্দ্রিক পশ্চিম রোম সাম্রাজ্য লিবিয়ার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে বর্তমান জমানার মতো কূটনৈতিক এবং গোপন সামরিক তৎপরতা চালাতে থাকে। ফলে মুসলিম রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে জড়িত খলিফা, গভর্নর, সেনাপতি, কাজীসহ সাম্রাজ্যের সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এই অবস্থায় হজরত আলী রা: রাজনৈতিক কারণে রাজধানী মদিনা থেকে ইরাকের কুফায় স্থানান্তর করেন। কারণ তার প্রতিদ্বন্দ্বী আমীর মুয়াবিয়া সিরিয়ায় বসে যে রাজনৈতিক সুবিধা পাচ্ছিলেন তা মোকাবেলা করার মতো দক্ষ জনবল, স্থাপনা এবং পরিবেশ মদিনায় সম্ভবপর ছিল না। বিষয়টি বোঝার জন্য ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। পারস্য সাম্রাজ্যের ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। এই সুদীর্ঘ সময়ে সাম্রাজ্যটি মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছাড়াও গ্রিস, সাইপ্রাস, তুরস্ক, মধ্য এশিয়া অর্থাৎ বর্তমান কাজাখিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, কিরঘিজস্তান, আফগানিস্তানের বৃহদংশসহ তুরস্কের একাংশ শাসন করত। কয়েক হাজার বছর ধরে পারস্য সাম্রাজ্য অত্যন্ত সফলতার সাথে পৃথিবীর সর্বকালের বৃহৎ ভূখণ্ড শাসন করেছে। ফলে সে দেশের জনগণের অস্থিমজ্জায় এক ধরনের আভিজাত্য বা রাজনীতির অহম স্থায়ীভাবে সৃষ্টি হয়ে গেছে। ফলে পারসিক জাতির ডিএনএ যুদ্ধ-রাজনীতি, কূটনীতি, সাম্রাজ্য পরিচালনা এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ মোকাবেলার জন্য বংশপরম্পরায় যেভাবে সচল এবং কার্যকর থাকে, সেভাবে পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি-গোষ্ঠীর ডিএনএ হয়তো কাজ করে না। এ কারণে বিদেশী শক্তি পারস্যে হানা দিয়ে স্থায়ীভাবে টিকতে পারেনি অথবা সেই দেশে হানাদাররা নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি ইত্যাদি চালু করতে পারেনি বরং পারস্য সংস্কৃতির মাঝে নিজেদের বিলীন করে দিতে হয়েছে।
পারস্যের সাম্রাজ্যে প্রথম আঘাত হানেন আলেকজান্ডার। যুদ্ধে পারস্যসম্রাট পরাজিত হলেও পারস্যবাসীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা, ঘৃণা ও অসহযোগিতার কারণে আলেকজান্ডার সেখানে টিকতে না পেরে মিসর, ইরাক ও জেরুসালেমে অভিযান পরিচালনা করে ওইসব এলাকায় প্রভুত্ব কায়েম করে ফেলেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার ইউরোপীয় বশংবদ সেনাপতি টলেমি মিসরকে কেন্দ্র করে উত্তর আফ্রিকা-নুবিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিয়দংশে নিজের আধিপত্য বজায় রাখেন, যা পরে প্রায় ৩০০ বছর অক্ষুণ্ন থাকে। অন্য দিকে, ইউরোপে গ্রিসের পতন এবং রোমের উত্থানের পর মিসরকেন্দ্রিক টলেমি বংশ রোমের অধীনতা মেনে নেয়। পরে রোম সাম্রাজ্য দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে কনস্টান্টিনোপল-কেন্দ্রিক পূর্ব রোম সাম্রাজ্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কর্তৃত্ব লাভ করে এবং তারা সিরিয়াকে প্রধান ঘাঁটি বানিয়ে শাসন করতে থাকে। ইসলামের বিজয়ের আগ পর্যন্ত পুরো মধ্যপ্রাচ্য মূলত দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। সিরিয়াকেন্দ্রিক রোমান সাম্রাজ্য এবং পারস্যকেন্দ্রিক পারস্য সাম্রাজ্য। পশ্চিমা শক্তি তথা গ্রিক নগর রাষ্ট্রসমূহ, আলেকজান্ডারের গ্রিস সাম্রাজ্য, অবিভক্ত জুলিও-ক্লডিয়াস রোমান সাম্রাজ্য, পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যসহ বর্তমানের ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির সাথে ইরানের সাম্রাজ্যগত বিরোধ হাজার বছরের এবং অতীতের প্রতিটি বিরোধেই তারা শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করেছে। মুসলমানরা যখন হজরত উমরের সময় পারস্য দখল করে, তখন পারস্য জাতি প্রথমবারের মতো আরব আধিপত্য মেনে নেয় এবং ইসলাম ধর্মে শামিল হয়ে পড়ে। তারা খিলাফতকে মেনে নেয় এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে নতুন সাম্রাজ্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে থাকে। কিন্তু হজরত আলী রা:-এর জমানায় আমীর মুয়াবিয়ার উত্থান ঘটে। সিরিয়াকেন্দ্রিক রোমান সাম্রাজ্যের সাবেক তাবেদার, আমলা এবং সেনাপতিরা যখন তার পক্ষ অবলম্বন করেন, তখন পারস্য জাতির প্রাচীন ঐতিহ্য এবং আভিজাত্যে আঘাত হানে। ফলে তাদের চিরাচরিত বিরোধিতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তারা হজরত আলী রা:-এর পক্ষালম্বন করেছিলেন এবং তাদের প্রভাবেই হজরত আলী রা: মদিনা থেকে তার রাজধানী কুফায় স্থানান্তর করেন বলে উল্লেখ করা হয়।
হজরত আলী রা:-এর হত্যাকাণ্ড এবং সিরিয়াকেন্দ্রিক উমাইয়াদের উত্থান পারস্যবাসী মেনে নিতে পারেনি। তারা উমাইয়াদের বিরুদ্ধে আল্লাহর রাসূল সা:-এর চাচা হজরত আব্বাস রা:-এর বংশধরদের সবরকম সাহায্য-সহযোগিতা করে উমাইয়া সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে বাগদাদকেন্দ্রিক আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে। পারস্যের সুবিখ্যাত বার্মেকি পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় তৎকালীন পারস্যের রে নগরী তথা আজকের তেহরানে আব্বাসীয় বংশের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আব্বাস আস সাফফাহ এবং খলিফা আল মনসুরকে আশ্রয় দিয়ে ইরানিরা আব্বাসীয় খিলাফত গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করে। বিখ্যাত বাদশাহ হারুন আল রশিদের জন্ম তেহরানে। তার বাবা খলিফা হাদির বেড়ে ওঠাও তেহরানে। আব্বাসীয় খলিফা ও রাজকুমারদের প্রায় সব স্ত্রীই ছিলেন পারস্য বংশোদ্ভূত। আজ যারা পারস্যকে ‘শিয়া রাষ্ট্র’ বলে সমলোচনা করেন এবং শিয়া-সুন্নি বিরোধ নিয়ে বড় বড় কথা বলেন, তারা ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাস না জেনে নিছক আবেগের ওপর ভর করেই মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ-বিসংবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছেন, বলা চলে। ধর্ম ও রাজনীতি এবং যুদ্ধনীতি সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান না থাকলে শিয়া-সুন্নি সম্পর্কে মন্তব্য করা অন্ধের হাতি দেখার মতো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। পারস্য জাতির উল্লিখিত ইতিহাস এবং মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক ইন্দো-মার্কিন রাজনীতির কূটচালে সৃষ্ট যুদ্ধ-বিগ্রহ, দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের অমানবিক স্বার্থ হাসিলের জটিল রসায়নে এবার ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নির্মমভাবে নিহত হন। দখলদার শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিকটস্থ কোনো সেনাঘাঁটি থেকে ড্রোনের মাধ্যমে আক্রমণ চালিয়ে বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করেছে। ইরান রাষ্ট্রীয়ভাবে এর প্রতিশোধ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান ব্যক্তি আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে সরাসরি রাষ্ট্রীয়ভাবে আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন। ইরাকে অবস্থিত বৃহত্তম মার্কিন সেনাঘাঁটিতে একাধিকবার ভারী ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণ চালিয়ে সেটিকে তছনছ করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাগদাদে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস লক্ষ্য করে একের পর এক আক্রমণ চলছে।
এহেন প্রতিশোধস্পৃহায় যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা ভীতসন্ত্রস্ত। জার্মানি-ফ্রান্স সরাসরি-মার্কিনিদের পক্ষে আর নেই। যুক্তরাজ্য চুপচাপ। মিসর, সৌদি আরব ও অন্যান্য ‘মিত্ররাষ্ট্র’ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। সোলাইমানিকে হত্যার পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ দিলেও বাগদাদের মার্কিন ঘাঁটিতে আক্রমণের পর তারা একদম চুপ। অন্য দিকে, ইরানের কৌশলগত মিত্র রাশিয়া-চীন-তুরস্ক মার্কিন আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে এবং ‘যেকোনো পরিস্থিতিতে’ ইরানের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে। ইরানের মিত্র বলে পরিচিত অন্যান্য দেশও ইরানকে মদদ দিচ্ছে। ফলে আফগানিস্তান থেকে ইরান-ইরাক, সিরিয়া-লেবানন-ইয়েমেন ও কাতারকেন্দ্রিক যে ভূখণ্ডগত সুবিধা এবং ওইসব দেশের জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন যেভাবে ইরানের পক্ষে রয়েছে, তাতে ইরানকে দমানো হয়তো সম্ভব নয়। এভাবে সার্বিক অবস্থা যে সম্পূর্ণ বিপরীতে চলে যাবে তা হয়তো ট্রাম্প প্রশাসন বুঝতে পারেনি। অধিকন্তু এই প্রথমবারের মতো মার্কিন জনমত, কংগ্রেস এবং বিচার বিভাগ সরাসরি যুদ্ধের বিরুদ্ধে। ফলে মার্কিন প্রশাসন যেকোনো মূল্যে ইরানের সাথে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাচ্ছে। ইরানের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়া, সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের ক্ষতিপূরণ প্রদান, ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে বাধা না দেয়াসহ কৌশলগত অনেক সুবিধা দিয়ে ইরানের সাথে সমঝোতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা চালাচ্ছে বলে পশ্চিমা গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছে। এ অবস্থায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ইরান কি এ ধরনের লোভনীয় প্রস্তাবে সায় দিয়ে তার দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা সন্তান এবং জাতীয় বীর জেনারেল কাসেম সোলাইমানির লাশ বিক্রি করে দেবে?’ নাকি পাল্টা কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে? ইরান কোনো মতেই মার্কিন অর্থ এবং প্রস্তাবের কাছে জাতীয় বীরের রক্ত বিক্রি করবে বলে মনে হয় না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য