খুলনায় বছর জুড়ে শ্রমিক অসন্তোষ

0

মো.জামাল হোসেন,খুলনা ॥ বছরের শুরু থেকেই শিল্পনগরী খুলনায় শুরু হয় শ্রমিক আন্দোলন। থেমে থেমে এ আন্দোলন সারা বছর ধরেই চলে। ১১দফা দাবিতে খুলনা অঞ্চলের ৯ টি পাটকলের শ্রমিকদের আন্দোলন এখনও অব্যাহত রয়েছে। দাবি আদায়ে সভা-সমাবেশ, মিল গেটে বিক্ষোভ, ভুখা মিছিল,সড়ক অবরোধ,মানব বন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন শেষে গত ২৮ ডিসেম্বর থেকে আবার শুরু হয়েছে পাটকল শ্রমিকদের আমরণ গণঅনশন। এতে ২ শ্রমিকের মৃত্যু এবং প্রায় দুই শতাধিক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়ে। খুলনা অঞ্চলে মোট রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকল রয়েছে। এর মধ্যে খুলনায় রয়েছে সাতটি ও যশোরে রয়েছে দু’টি। পাটকলগুলো হলো ক্রিসেন্ট জুট মিল, খালিশপুর জুট মিল, দৌলতপুর জুট মিল, প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিল, স্টার জুট মিল, আলিম জুট মিল, ইস্টার্ন জুট মিল, কার্পেটিং জুট মিল ও জেজেআই জুট মিল। এসব মিলে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক রয়েছে। বছরের শুরু থেকেই বকেয়া মজুরীর দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয় খুলনার শিল্পাঞ্চলে। দফায় দফায় সড়ক অবরোধ,বিক্ষোভ মিছিল আর সভা সমাবেশের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে আন্দোলন। পরবর্তীতে খুলনা এবং ঢাকায় কয়েক দফা বৈঠকের পর আন্দোলন স্থগিত করা হয়।
দাবিসমূহ : ১১ দফার মধ্যে বকেয়া মজুরি পরিশোধ ও পাটকল শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত মজুরি কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন এ মূহুর্তে আন্দোলনরত শ্রমিকদের মূল দাবী। এছাড়া পাটের মৌসুমে চাহিদা অনুযায়ী পাট কেনার জন্য মিলগুলোকে পযাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া, পাটকলে বর্তমানে কার্যকর পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ব্যবস্থা বাতিল করা, বদলি শ্রমিকদের স্থায়ী করা, টার্মিনেশন ও বরখাস্ত সব শ্রমিক-কর্মচারীদের পুনর্বহাল করা, পিচ রেট (ঘণ্টা অনুযায়ী মজুরি) শ্রমিকদের গড় মজুরি দেওয়া, অবসর ও মৃত্যু বীমার পাওনা পরিশোধ করা ( পিএফ ও গ্র্যাচুইটির টাকাসহ), নিজ নিজ মিলের পিএফ ফান্ডের টাকা আবার ওই ফান্ডে ফেরত দেওয়া, শ্রম আদালত ও আপিল ট্রাইবুনালের যে কোনো রায় পুনর্বহাল রাখা, শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে শ্রমিকদের কাজ বন্টন করা এবং মিলে কর্মচারী নিয়োগ করার ক্ষমতা আবার মিল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা,সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের সিদ্ধান্ত বাতিল ও অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের পিএফ ও গ্র্যাচুইটির টাকা প্রদান,পাটকলগুলো আধুনিকীকরণের মাধ্যমে লাভজনক শিল্পে পরিণত, পিপিপি’র প্রকল্পে নয় সরকারী উদ্যোগে পাটকলের মেশিন পত্র আধুনিকীকরণসহ উৎপাদন বৃদ্ধি করার দাবীও জানাচ্ছে আন্দোলনকারী শ্রমিকরা। শ্রমিক নেতৃবৃন্দ জানান,সরকারি কর্মচারীদের জন্য পে-স্কেল ঘোষণা ও বাস্তবায়ন হয়েছে ২০১৫ সাল থেকে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শ্রমিকদের জন্য মজুরি কমিশন ঘোষণা হয়েছে ২০১৫ সালে। এমনকি চিনি, খাদ্য, শিল্পসহ অন্যান্য সেক্টরে তা বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু,উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পাটকল শ্রমিকদের ২০১৫ সালে ঘোষিত মজুরি কমিশনের রোয়েদাদ এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ ১১ দফা দাবিতে গত ১৭ নভেম্বর ৬ দিনের কর্মসূচির ঘোষণা দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদ। ভুখা মিছিল, মিল গেটে প্রতীকী অনশন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। গেট সভা ও শপথগ্রহণ এবং ১০ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে নিজ নিজ মিল গেটে আমরণ গণঅনশন শুরু করে তারা।
উল্লেখ্য, কেবল খুলনা অঞ্চলেই রাষ্ট্রায়ত্ত নয়টি পাটকলের শ্রমিকদের ১০ থেকে ১১ সপ্তাহের মজুরি, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চার মাসের বেতন বাবদ ৫৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। বিজেএমসি কর্মকর্তারা বলছেন, কার্যকরী মূলধন না থাকায় কাঁচা পাটের মজুদ নেই। ফলে উৎপাদনও কমেছে। বর্তমানে মিলগুলোয় উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ২০ শতাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে তাদের লোকসানের পরিমাণ বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক খলিলুর রহমান জানান, অনশন কর্মসূচি চলাকালে এ পর্যন্ত দুজন শ্রমিক মারা গেছেন। কর্মসূচির চতুর্থ দিন শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) অসুস্থ ১ শ্রমিকের মৃত্যু এবং প্রায় দুই শতাধিক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থদের খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মারা যাওয়া প্লাটিনাম জুটমিলের মৃত শ্রমিক আব্দুস সাত্তারের জানাজা জানাযা শেষে খুলনা বিভাগীয় শ্রম কর্মকর্তা মিজানুর রহমান নগদ ৫০হাজার টাকা তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন।
পরবর্তিতে গত (১৫ ডিসেম্বর) প্লাটিনাম জুট মিলের ম্যাকানিক্যাল বিভাগের শ্রমিক সোহরাব খুমেক হাশপাতালে মারা যায়। সে অনশন ধর্মঘট কালে অসুস্থ হয়ে মনিষা কিনিকে ভর্তি হয়। সুস্থ্য হয়ে কাজে যোগ দেয়। নিউজপ্রিন্ট মিল গেটের বাসায় থাকা অবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে খুমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসা অবস্থায় সে মারা যায়।
পাটকল শ্রমিক আন্দোলনের বিষয় নিয়ে ১৫ ডিসেম্বর বিজেএমসিতে শ্রমিক নেতাদের সাথে পাট মন্ত্রী,শ্রম প্রতিমন্ত্রী ও বিজেএমসির চেয়ারম্যানের বৈঠকে হয়েছে। এ বৈঠকে মন্ত্রী ২২ ডিসেম্বর পযর্ন্ত সময় নিয়েছেন। শ্রমিক নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ২২ ডিসেম্বর পযর্ন্ত তারা ঢাকায় অবস্থান করবেন। চুড়ান্ত খবর না নিয়ে স্ব স্ব মিলে ফিরবেন না। সর্বশেষ গত ২৭ ডিসেম্বর তৃতীয় দফায়বৈঠকে খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য বেগম মুন্নজান সুফিয়ানসহ পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিজেএমসি’র চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পাটকল শ্রমিক লীগ এবং সিবিএ-ননসিবিএ উপস্থিতে আলোচনা ফলপ্রসু না হওয়ায় আবারও আমরণ অনশনে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও ক্রিসেন্ট জুট মিলের সাবেক সিবিএ সভাপতি মোঃ মুরাদ হোসেন বলেন, আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। সভায় এক মাসের সময় চাওয়া হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের পে ওই সময় দেওয়া সম্ভব নয়। শ্রমিকদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাই আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। শ্রমিকদের এখন মাত্র একটিই চাওয়া আর তা হলো মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন। তাঁদের সেই দাবি পূরণ না হলে তাঁরা কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য। পাটকল শ্রমিক নেতারা জানায়, গত ১৩ ডিসেম্বর রাতে খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তিনদিনের জন্য আমরণ অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেছিলেন শ্রমিকরা। ভালো কিছু সংবাদের অপোয় ঢাকায় থাকা শ্রমিক নেতাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন পাটকলের শ্রমিকরা। কিন্তু তাঁদের জন্য ভালো কোনো বার্তা আসেনি। এমন প্রেক্ষিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে খুলনায় থাকা পাটকল শ্রমিকদের মধ্যে। প্লাটিনাম জুট মিলের সিবিএ সভাপতি শাহানা শারমিন বলেন, ২৯ ডিসেম্বর থেকে আবারও জুট মিলের শ্রমিকরা প্যান্ডেল করে কাঁথা বালিশ নিয়ে ফের আমরণ গণঅনশনে বসেছে। কর্মসূচি পালন করতে শ্রমিকদরা প্রস্তুত আছে। শ্রমিকরা এবার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত উঠবো না।