জেলা পরিষদের প্রকল্প বিক্রি করতেন পিকুল

0

তহীদ মনি ॥ যশোর জেলা পরিষদের পলাতক চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল প্রকল্প বিক্রির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার সময়ে জেলা পরিষদের চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারী পিকুলের পক্ষে ৮ কোটির অধিক টাকার প্রকল্প বিক্রি করে নিজেও ভাগ বসিয়েছিলেন। ওই ভাগের টাকায় যশোর শহরে ওই কর্মচারীর জমি ও বাড়ি হয়েছে। প্রকল্পগুলো বিক্রি হতো ২০ থেকে ৪০ শতাংশ কমিশনে। কোনো প্রকল্পে ১০ লাখ টাকা নিতে হলে আগেই ২ লাখ টাকা দিতে হতো অফিস সহায়ক ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার উদ্দিনের মাধ্যমে চেয়ারম্যানের কাছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) লুৎফর রহমানও যুক্ত হতেন।

জেলা পরিষদের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ২০২১-২২. ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪ এই ৩ অর্থ বছরে প্রায় ২৮ কোটি টাকার প্রকল্প পাস করেছে জেলা পরিষদ। এর মধ্যে এডিপি (সরকারি বরাদ্দ)-এর ১৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা এবং রাজস্ব (নিজস্ব অর্থায়ন) খাতের প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এই টাকায় ৭৫২টি প্রকল্পের কাজ অনুমোদন হয়।

সূত্রগুলো আরও জানায়, ব্যয় অনুমোদনের ক্ষেত্রে একটা রেওয়াজ ছিল চেয়ারম্যানের। মোট বরাদ্দের ৬০ ভাগ জেলা পরিরষদের ১১ সদস্য এবং ৪০ ভাগ সরাসরি নিজে খরচ করতেন বা প্রকল্প অনুমোদন দিতে পারতেন।

সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আগে প্রকল্প জমা দিতে হতো এবং সেখান থেকে পাস হলে সে প্রকল্পে অর্থ অনুমোদন দিত জেলা পরিষদ। মন্ত্রণালয়ের কাজ করাতে ব্যস্ত থাকতেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা লুৎফর রহমান ও প্রকৌশল শাখা। আর প্রকল্পের ফাইল মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন হলে তা হতো ভাগবাটোয়ারা।

সেই ৬০ ভাগ সদস্যরা পেলেও সবাই সমানভাবে পেতেন না। ক্ষমতা ও প্রভাব অনুসারে তার রকম ফের হতো। আর প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর আগেই লাখে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা দিতে হতো চেয়ারম্যান পিকুলের কাছে।

এ কাজে সবচেয়ে বেশি সহায়ক ছিলেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সরোয়ার উদ্দিন। আগেভাগে টাকা না দিলে সে প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হতো না। আবার মন্ত্রণালয় থেকে পাস করিয়ে আনতে বিভিন্নভাবে নাকি সেখানকার ঊর্ধ্বতনদের খুশি করতে হতো বলেও দাবি একাধিকসূত্রের।

সূত্র মতে, ২০২১-২২ অর্থ বছরে এককালীন সবচেয়ে বেশি টাকার প্রকল্প ছিল অভয়নগরে বিপুল ফারাজির বাড়ি এলাকায় সাড়ে ১৩ লাখ টাকার রাস্তা। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বেশি ব্যয়ের প্রকল্প ছিল মণিরামপুর হোগলাডাঙ্গা দাসপাড়া মন্দির সংস্কার ও নির্মাণে ১৫ লাখ টাকা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যশোর সদরের কুন্দিয়ানি জামে মসজিদের নির্মাণ ও সংস্কারে ২০ লাখ টাকার প্রকল্প।

স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, রাস্তা, কবরস্থান সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনে যশোরবাসী প্রকল্প জমা দিতেন। এর থেকে বাছাই করা প্রকল্পগুলো অনুমোদনের জন্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হতো। সব প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হতো না, তাই আগ্রহীরা যোগাযোগ শুরু করলে জেলা পরিষদের কর্মচারীরা পথ বলে দিতেন, শুরু হতো সরোয়ারের মাধ্যমে লেনদেন পর্ব।

মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প পাস করাতে তৎকালীন মন্ত্রণালয়ের জেলাপরিষদ শাখার যুগ্ম সচিব তানভীর আলম সিদ্দিকীর অনুরোধে প্রশাসনিক কর্মকর্তা লুৎফর রহমান ৫৯ লাখ টাকার প্রকল্প ওই যুগ্ম সচিবের পছন্দের লোককে দিয়েছেন বলে লুৎফর রহমান স্বীকার করেছেন।

সূত্র জানায় সরোয়ার ২২-২৩ ও ২৩-২৪ এই দুই বছরে চেয়ারম্যানের প্রকল্পের প্রায় কোটি টাকার প্রকল্প বিক্রি করেছে। অভিযোগ রয়েছে যশোর সাড়াপোল মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২০২৩-২৪ সালে ১৫ লাখ টাকা রবরাদ্দ পায়। এ জন্যে মোটা অংকের টাকা উৎকোচ দিতে হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে, স্কুলের প্রধান শিক্ষক পাপিয়া খাতুন জানান, যেভাবেই হোক টাকাটা বরাদ্দ হয়েছে, এখন লেখালেখি ও জানাজানি হলে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে, এতে ক্ষতি হবে।

একাধিক সূত্র জানায়, ২লাখ টাকা দিয়ে মণিরামপুরের বারপাড়া বালক বালিকা কওমী মাদরাসা ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ নিয়েছে। জানতে চাইলে মাদরাসার মুহতামিম জাকির হোসেন ফোনে বেশ কিছুক্ষণ আমতা আমতা করেন।

তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে মোটেই এড়িয়ে যাননি চৌগাছা উপজেলার বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম। তিনি জানান, তিনি স্বরুপদাহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন। ওই স্কুলে শহীদ মিনার ও অন্য কাজের জন্যে দুই বার ৩ লাখ করে টাকা নিয়েছেন। প্রতিবার সরোয়ার তার কাছ থেকে এক লাখ করে টাকা নিয়েছেন। সরোয়ারের গ্রামে তেমন জমি ছিল না। এখন শহরেও তার দোতলা বাড়ি ও জমি হয়েছে, এলাকায় পরিষদের গাছ কাটা-বিক্রি সবই সেই করতো আর সে সব টাকার অংশ পৌছেঁ যেতো চেয়ারম্যানের কাছে।

আব্দুস সালাম আরও জানান, বাঘাদদড়ি মসজিদে একলাখ টাকার প্রকল্প দিতে সরোয়ারকে দিতে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। গ্রামে বহু এমএ পাস, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদ রয়েছে। অথচ সরোয়ার টাকার জোরে স্বরূপদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এডহক কমিটিতে নিজের ছেলে মেজবাহুল হককে সভাপতি করিয়ে নিয়েছিলেন।

এ কাজে সহযোগিতা করেছেন প্রধান শিক্ষক। তিনিসহ গ্রামের সবাই সরোয়ারের এই ক্ষমতার উৎস হিসেবে জেলাপরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুলকেই জানেন। এ কারণে ওই মুক্তিযোদ্ধা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদকে) অভিযোগ করেছেন বলেও জানান। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় সরোয়ারের বিরুদ্ধে খবরের কাগজেও অনেক কিছু লেখা হলেও তার কিছু হয়নি।

জেলা পরিষদ সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পর সরোয়ার উদ্দিনকে মেহেরপুরে, প্রশাসনিক কর্মকর্তা লুৎফরকে নড়াইলে বদলি করা হয়। কয়েক মাস যশোর জেলা পরিষদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পেয়েছিলেন আলমগীর হোসেন। সম্প্রতি জেলা পরিষদের সম্পদ নিয়ে জেলা সমন্বয় সভায় আলোচনা-সমালোচনা ওঠার পর তিনিও যশোরের দায়িত্ব ছেড়ে নিজ কর্মস্থল নড়াইলে ফিরে গেছেন। সূত্র জানায়, তার নামেও অর্থ গ্রহণের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

জেলা পরিষদের একাধিক সূত্র জানায়, এভাবে যে যখন যে দায়িত্ব পেয়েছে সে তার মতো সাজিয়ে ঊধর্বতনকে খুশি করেছে। উদাহরণ হিসেবে ওই সূত্র দাবি করে যশোর অভয়নগরে মজুমদার গ্রুপকে প্রায় ২৩ শতক জমি তাদের মিলে ব্যবহারের জন্যে দেওয়া হয়েছে। ওই জমি রাস্তার পাশে ও মিলের মধ্যে হলেও কৃষি জমি হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর ২০১০ সাল থেকে ওই জমি বাবদ কোনো টাকা জেলা পরিষদের ফান্ডে জমা হয়নি। এভাবে প্রতিখাতে প্রতিটি কাজে জেলা পরিষদকে উপেক্ষা করে কর্তব্যরতরা এবং সর্বশেষ ১০ বছর চেয়ারম্যান নিজেই নিজের সম্পদ বানিয়ে আয় করেছেন কোটি কোটি টাকা।

যশোর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আছাদুুজ্জামান জানান, প্রকল্প বিক্রির মাধ্যমে টাকা আয়ের বিষয়টি তিনি শুনেছেন। তবে লিখিত অভিযোগ কেউ করেনি। তিনি স্বীকার করেন, এখানে কোনো নিয়ম খুঁজে পাননি তিনি এখনো। তদন্ত হওয়ারও দরকার সব বিষয়ে। মজুমদারসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ম ভাঙার খবর তিনি শুনতে পেয়েছেন।

তবে ওই কর্মকর্তা দাবি করেন, এখন থেকে কাউকে প্রকল্প পেতে অর্থ ব্যয় করতে হবে না। ইতোমধ্যে জেলা সমন্বয় সভায় স্পষ্ট করেই এখানকার অনিয়ম তুলে ধরা হয়েছে। আগামীতে আরো স্পষ্ট করা হবে।