সুজায়েত শামীম সুমন ।। সর্বশেষ তথ্যমতে বৈম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা ১,৫৮১ এবং আহত ৩১ হাজার। স্বাস্থ্য বিষয়ক উপ কমিটির এক সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তবে এই সংখ্যাটি এখনও চূড়ান্ত নয় বলে সংশ্লিষ্টরা উল্লেখ করেছেন। এদিকে প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় উঠে আসছে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা আহতদের মৃত্যুর খবর।
কোটা সংস্কারের মত একটি যৌক্তিক দাবিতে ছাত্রদের চলমান আন্দোলন শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেওয়ার পেছনে সরকারের ভয়ঙ্কর রকমের দুঃশাসন এবং স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়। বিশেষ করে বিএনপিসহ গণতন্ত্রকামী প্রতিটি রাজনৈতিক দলের আন্দোলন দমনে অবিশ্বাস্য রকমের বল প্রয়োগ এবং সর্বশেষ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা সাধারণ মানুষের অন্তরে এত বেশি ক্ষত সৃষ্টি করে যে; নিজের জীবন কিংবা বাঁচা মরা নিয়ে কেউ কোন পরোয়া করেননি। ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তথা সর্বস্তরের মানুষ এক দফা দাবিতে রাজপথে সামিল হতে শুরু করেন দলে দলে। এতে করে ভূতগ্রস্ত হয়ে সরকার ও তাদের রাজনৈতিক দলটি আরও বেশি নৃশংস হয়ে ওঠে।
দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছরের দুর্দান্ত দাপট এবং অদম্য ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ঘটাতে ঘটাতে আত্মবিশ^াসী হয়ে ওঠা আওয়ামী লীগ নামের এই রাজনৈতিক দলের নীতি নির্ধারকরা বরাবরের মত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীকে কেবল জনগণের মুখোমুখি হতে বাধ্য করেননি; সারাদেশে দলীয় নেতা কর্মীদের আন্দোলন প্রতিহত করার কঠোর নির্দেশ প্রদান করেন। ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা হিসাবে শেষ পর্যন্ত তারা এতটাই নির্লজ্জ এবং বিবেকহীন হয়ে ওঠে যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আন্দোলনরত মানুষের ওপর তাদের হামলে পড়ার অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ে নেট দুনিয়ায়।
দেশি বিদেশি একাধিক সংবাদ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হস্তগত হয়েছে তাদের নানা পর্যায়ের নেতাকর্মীর মানবতা বিরোধী অপরাধের তথ্যচিত্র। অতীতে বিভিন্ন সময়ে পুলিশের পাশাপাশি দলীয় পেশীশক্তির প্রয়োগ ঘটতে দেখা গেছে কমবেশি প্রতিটি সরকারের আমলে। তবে এবারের মত এতটা ভয়াবহ এবং অবিশ^াস্য রূপ অতীতে কখনও দেখেনি এ দেশের মানুষ। সরাসরি আন্দোলনরত মানুষকে নির্বিচারে হত্যার মিশন নিয়ে দলীয় ক্যাডারদের ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণাজনক এক বিরল অধ্যায়।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে নিজ দেশের নাগরিকের ওপর গণহত্যা চালানো এই রাজনৈতিক দলের প্রতি এরপরও কি অনুকম্পা দেখানোর মত “বিবেক” সায় দেয়? যেখানে লাশের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত দেড় হাজার। মিসিং হওয়া মানুষের সংখ্যা অগণিত। খোঁজ মিলছে একাধিক গণকবর। অন্ধত্ব বরণ করেছেন চার শতাধিক মানুষ। ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে গেলে দেখা যাবে কত সংখ্যক নিরীহ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে বিছানায় কাতরাচ্ছেন। এদের কেউ কেউ সাধারণ পথচারী। ঘটনাচক্রে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়ে মর্মান্তিকভাবে আহত হয়েছেন। এদের কেউ ড্রাইভার, কেউ দিনমজুর, কেউ পানবিড়ির দোকানি, কেউ বা সিকিউরিটি গার্ড। নিউরো সায়েন্স হসপিটালে গেলেও দেখা যায় মাথায় গুলিবিদ্ধ কিংবা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে রয়েছেন শ শ মানুষ।
এত বড় মানবিক অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট এই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা নিজস্ব পরিচয়ে ফিরে আসার মত কোন পথ কি খোলা রাখতে পেরেছেন?
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন, জুলাইয়ের আন্দোলন দমনে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সকলেই যে দলকানার মত সমর্থন দিয়ে গেছেন এমনটি নয়। সারা দেশে খোঁজ করলে আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির নেতাকর্র্মী ও সমর্থকের দেখা মিলবে; যাদের পালানোর প্রয়োজন পড়েনি। তারা দুর্বৃত্তায়নে যুক্ত হয়ননি, মানুষের ওপর অবিচার করেননি, কারোর অর্থ সম্পদ কেড়ে নেননি বা ভাগ বাটোয়ারাতে অংশ নেননি। বরং তারা দলের সাম্প্রতিক কর্মকাÐ নিয়ে চরমভাবে লজ্জিত। তবে সামগ্রিকভাবে গণমানুষের কাছে চরম নিন্দনীয় এবং ঘৃণিত হিসাবে প্রতিফলিত হয়েছে আওয়ামী লীগ নামের এই রাজনৈতিক দলটি।
কোটা সংস্কারের আন্দোলন শুরুতেই সমাধান করা যেতো; প্রতিহতের নির্দেশ না দিয়ে বরং পরিস্থিতি বিবেচনায় দু একজন মন্ত্রীকে পদত্যাগে করানো যেতো। আবু সাইদের গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের সাথে সাথে ক্লোজ করা হলে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মাত্রা কিছুটা হলেও প্রশমিত হতো। ধ্বংসস্তুপ দেখার জন্য ছুটে না গিয়ে বরং সবার আগে হাসপাতালে যেতে পারতেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাস্তবতা হলো এই সবকিছু তিনি করলেন; আবু সাইদের ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশকে বরখাস্ত করলেন, ধ্বংসস্তুপ দেখা শেষে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে গেলেন এবং সর্বশেষ দেখতে গেলেন আন্দোলনে আহতদের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পলাতক আসাদুজ্জামান কামাল সংবাদ সম্মেলন করে সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণাও দেন।
শেখ হাসিনা বা তার রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা কোনকিছু কে পাত্তা দিতে চাননি। কেননা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিটি স্তরে রয়েছে তাদের লোক, বড় বড় ব্যবসায়ীরা রয়েছেন সভানেত্রীর সাথে; অর্থবিত্ত, অস্ত্র, ভাড়াটে মানুষের কোনো অভাব নেই দেশজুড়ে। কিন্তু মানুষের নিয়তি বড় অদ্ভুত! এতকাল যে খেলেছে বা যার খেলা দেখে মাঠ ভর্তি দর্শকের করোতালিতে গমগম করতো গোটা স্টেডিয়াম; তাকে নিয়ে খেলাধুলা হচ্ছে। আবার “খেলা হবে, খেলা হবে” বলে যিনি হুংকার দিতেন; তিনি এখন মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়ােেচ্ছন। ‘হায় রে জ্বালা অন্তর জ্বালা’ বলে যিনি টিটকারী মেরে যেতেন প্রতিনিয়ত; তিনি এখন আর ঘুমাতে পারেন না সর্বহারা জীবন যন্ত্রণায়।
বিশাল প্রাপ্তির পর ছোটখাটো আকাঙ্খার প্রতি হাত না বাড়ানোই উত্তম। যেটা সাকিব আল হাসান করেছেন। ক্রিকেট অঙ্গনে যে মানুষটি তার পারদর্শিতার কারণে খ্যাতির চূড়ায় উঠে গেছেন; তিনি এমন একটি নির্বাচনে অংশ নিলেন, যেখানে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিষয়টি তারাও যেমন উপলব্ধি করতেন; জনগণও বুঝতে পারতো। জনগণকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার প্রক্রিয়া তারা অবলম্বন করে চলেছেন একেক সময়ে একেক কায়দায়। এমন বিতর্কিত ভোটে এমপি হবার লোভ কেনো সংবরণ করতে পারলেন না সাকিব আল হাসান!
নিজের ক্ষমতার ওপর অতিমাত্রায় বিশ্বাসী হওয়া বিপদজনক। আত্ম অহঙ্কার এতটাই ভয়ঙ্কর যে পতন অনিবার্য। এই বাস্তবতা এবং নীতি বাক্য কি অনুধাবন করতেন না ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা? অবশ্যই করতেন; কিন্তু তারা সকলে ধরেই নিয়েছিলে তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করারা মত শক্তি এবং ঐক্যবদ্ধ হবার সাহস এ দেশের মানুষের নেই। অথচ এ দেশের মানুষ নিজের জীবন দিয়ে, অঙ্গহানী ঘটিয়ে প্রমাণ করে দিলো স্বেচ্ছাচারিতার ঠাঁই নেই।
জুলাইয়ের আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থানের পুরো ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায় ১৫ জুলাই থেকে শুরু হয় নিরাপত্তা বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে হেলিকপ্টর থেকে গুলি চালানো হয়। প্রথম আলো পত্রিকায় ১৮ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় বগুড়ার উপশহরের পথ পাবলিক স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র জুনাইদ ইসলাম রাতুল, নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলাকালে বাসার ছাদে শিশু রিয়া ঘোষ, আমিনুল ইসলাম, শাফিক উদ্দিন আহমেদ, গোলাম নাফিজসহ ৬০ জন শিশুর মৃত্যু হয়। এর দায় কি কোনভাবে অস্বীকার করতে পারবেন; যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন?
১৫ জুলাইয়ের পর থেকে সরকারের আগ্রাসী ভ‚মিকা বাড়তে থাকে। ২০ জুলাই সারা দেশে ৫৬ জন মারা যায় এবং বিগত দুই দিনের হিসাবে নিহতের সংখ্যা শতাধিক। এতে করে কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পাড়া মহল্লায় বøক রেড দিয়ে পাকড়াও করে নিয়ে যাওয়া হয় আন্দোলনকারীদের। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও আটক হতে থাকেন গণহারে। অপরদিকে সরকারি দলের নেতা কর্মীরা পাড়া মহল্লায় ছাত্র ছাত্রীদের বাঁধা প্রদান, কোথাও কোথাও রক্তাক্ত জখম করে যেন কেউ আন্দোলনে অংশ নিতে না পারে। এতে করে আন্দোলন দমনে কিছুটা সফলতার মুখ দেখতে পেয়ে সরকারের দাম্ভিকতা বেড়ে যায় বহুগুণ। ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠকে সেটির প্রকাশও ঘটান ক্ষমতাচ্যুত প্রধামন্ত্রী।
কিন্তু পরবর্তী পরিস্থিতি এক দফা থেকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিতে শুরু করলে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ে সরকার। পুলিশেকে সরাসরি বুকে ও মাথায় গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তাই তো ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায় ডিএমপির ডিসি ইকবাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটি ভিডিও ক্লিপ দেখিয়ে বলছেন, ‘গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, ব্যাক যায় না। এটাই হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতংকের এবং দুশ্চিন্তার।”
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো পুলিশ বাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে বৃহত্তর একটি শ্রেণিকে নিজেদের মত করে বীভৎস্য মানসিকতায় পরিণত করাতে যথেষ্ট সফল হয়েছে আওয়ামী লীগ। এই ভিডিও ক্লিপে পুলিশের বক্তব্য, স্বরাষ্ট্র সচিবের নির্লিপ্ততা এবং আন্দোলনের পুরো সময় জুড়ে তাদের জনবিরোধী তৎপরতা দেখে এমনটি অনুমান করা যায়। বিশেষ করে ভ্যানের ওপর লাশের স্তুপ, পুলিশের সাঁজোয়া জানের ওপর থেকে আশহাবুল ইয়ামিনকে ফেলে দেওয়ার সেই ভিডিওর কথা কিভাবে ভুলবে মানুষ! তখনও তার প্রাণ স্পন্দন ছিল।
পরপর তিনটি নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট ছাড়া ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের কি একবারও মনে হয়নি; অনেক হয়েছে এবার লাগাম টানা উচিৎ। অথচ ৩ আগস্ট রাত থেকেই অস্ত্র হাতে আরো নিষ্ঠুরভাবে মাঠে নামে শাসকগোষ্ঠীর নেতাকর্মীরা। কিন্তু ততক্ষণে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যারাকে ফিরতে শুরু করে পুলিশ। মাঠে সেনা বাহিনী থাকলেও পুলিশের কমতি থাকায় বিচলিত হয়ে সরকারের হাই কমান্ড দলীয় ক্যাডারদের আরো বেশি সক্রিয় হবার নির্দেশ দেয়। ৪ আগস্ট শেষ কামড় দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। পৌঁছে যায় নৃশংসতার চরমে।
চিরন্তন সত্য এটাই যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ নামের এই রাজনৈতিক দল তাদের নিষ্ঠুরতার সর্বোচ্চ স্তর দেখিয়ে দিলো। জুলাইয়ের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশবাসী প্রমাণ পেলো তাদের হিং¯্রতার ভয়ঙ্কর রূপ। এরপরও কি এই রাজনৈতিক দলের মানসিকতা, নিষ্ঠুরতা, প্রতিহিংসা এবং বিগত দিনগুলিতে রাজনৈতিক, সাংবাদিক, লেখক, কার্টুনিস্ট, মানবাধিকারকর্মীসহ প্রায় সকল পেশার প্রতিবাদী মানুষের ওপর চালানো নানা স্তরের নির্যাতনের দৃষ্টান্ত নিয়ে নতুন করে বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে কি?
এতকিছুর পরও আকার ইঙ্গিতে কিংবা পরোক্ষভাবে আপনি যদি গণহত্যা পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দলটির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেন কিংবা সমর্থন করেন; আপনি আসলে ‘মানুষ’ নন – অন্য কিছু।