পানির স্তর নামছে ক্রমশ ঘণীভূত হচ্ছে সংকট

0

আকরামুজ্জামান ॥ যশোর শহরসহ জেলার অধিকাংশ উপজেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। চলতি বছরে গরম শুরু হওয়ার আগেই এসব এলাকার অধিকাংশ পাম্প ও নলকূপে পানি উঠছে না। ফলে সুপেয় ও গৃহস্থালির কাজে পানির সংকটে এসব এলাকার মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। প্রচ- দাবদাহ, প্রত্যাশিত বৃষ্টি না হওয়ার পাশাপাশি বেশির ভাগ পুকুর ও জলাশয় ভরাট, বহুতল ভবন নির্মাণ ও অপরিকল্পিত সাবমারসিবল পাম্প স্থাপন ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে ক্রমেই নিচে নামিয়ে দিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
গত কয়েক বছর ধরেই যশোরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে। তবে এ বছর গরম শুরু হওয়ার আগে ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই স্তর নামতে শুরু করে। যা চলতি এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে প্রকট আকার ধারণ করছে।
যশোর পৌরসভার পানি সরবরাহের সাথে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত পৌরসভার পানি বিভাগের সুপারভাইজার ইসাহক হোসেন বলেন, এ বছর পানি পরিস্থিতি অন্যান্য বছরের চেয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সাধারণত পৌরসভা এলাকায় পানির স্তর ২০ ফুটের নিচে নামলে হস্তচালিত নলকূপ থেকে পানি ওঠে না। যদি তা ২২ থেকে ২৩ ফুটের নিচে নেমে যায়, তাহলে বাসাবাড়িতে মোটর (সাধারণ পাম্প) দিয়ে পানি তোলাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। অথচ এই মুহূর্তে পৌরসভার স্থিতি ওয়াটার লেভেল রয়েছে ৩৫ থেকে ৩৬ ফুট। যা নিশ্চয় হতাশাজনক। তিনি বলেন, যশোর পৌরসভায় গভীর উৎপাদন নলকূপ রয়েছে ২৮টি। তারমধ্যে ১০টি রয়েছে ত্রুটিযুক্ত। ত্রুটিযুক্ত এই ১০টি উৎপাদন গভীর নলকূপ পুনঃখননে জরুরি হয়ে পড়েছে। এর বাইরে ফুল তারা টিউবওয়েল ১৫০টি ও ৫০টি সেমি তারা টিউবওয়েল রয়েছে। আপাতত এসব টিউবওয়েলে পানি উঠলেও সহসা বড় ধরনের বৃষ্টি না হলে সংকট আরও ঘণীভূত হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।
পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী বিএম কামাল হোসেন বলেন, এই সময়ে প্রতিবছরই পানির ভূগর্ভস্থ স্তর নেমে যায়। এটি সামনে আরও প্রকট হবে বলে তিনি জানান।
প্রায় একই কথা বলেন, বিএডিসি যশোরের সেচ বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী মো. মাঝহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ার কারণে এবছর অনেক আগে থেকেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তুর নামতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে বিএডিসি সেচ বিভাগের দেওয়া সেচ পাম্প এলাকায় পানির লেভেল ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ মিটার বলে তিনি জানান। আর এক থেকে দুই মিটার নিচে নেমে গেলে এসব সেচ যন্ত্রে পানি ওঠা দুষ্কর হয়ে পড়বে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, তার সেচের আওতায় এলএলপি গভীর নলকূপ রয়েছে ১২৮টি ও গভীর নলকূপ রয়েছে ১২০টি।
এর বাইরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে ১৭৮১টি গভীর নলকূপ, ৫০২৬৭ টি অগভীর নলকূপ ও সৌর বিদ্যুৎ চালিত ১৩টি অগভীর নলকূপ। এসব গভীর ও অগভীর নলকূপে পানি তুলতে কৃষকদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্যমতে, সাধারণত পানির স্তর ২২ থেকে ২৫ ফুটের নিচে নেমে গেলে যশোরের শহর ও গ্রামাঞ্চলে নলকূপে পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এবছর এই মুহূর্তে জেলার ৮ উপজেলাতেই পানির স্তর নেমে গেছে ৩৫-৩৮ ফুট। যেকারণে অধিকাংশ টিউবওয়েলেই পানি উঠছে না। যেকারণে শহর অঞ্চলের মানুষের পাশাপাশি গ্রামের অঞ্চলের মানুষের মানুষকে সুপেয় ও ব্যবহৃত পানি পেতে বেগ পেতে হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদ পারভেজ বলেন, গত কয়েক বছর ধরে ওয়াটার টেবিলের লেয়ার নিম্নমুখী। ওয়াটার লেভেল নেমে যাওয়ার কারণে সুপেয় পানির যাতে সঙ্কট না হয় সে জন্য উপজেলা পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সাবমারসিবলের পানি সরবরাহ নিশ্চিত রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান জেলায় ১২৫০০টি সাবমারসিবল পাম্পযুক্ত নলকূপ চালু আছে। এই মুহূর্তে যশোর সদর উপজেলায় পানির স্থিতিতল ৩৪ ফুট,বাঘারপাড়ায় ২৭ ফুট, ঝিকরগাছায় ২২ ফুট, চৌগাছায় ৩২ ফুট, শার্শায় ৩৪ ফুট, অভয়নগরে ১৮ ফুট, মনিরামপুর উপজেলায়৩০ ফুট ও কেশবপুর উপজেলায় ২৩ ফুট বলে তিনি দাবি করেন।
তিনি বলেন, যেসব এলাকায় ৩০ ফুটের নিচে পানির স্তর নেমে গেছে সেখানে ৬নং হ্যান্ড পাম্মযুক্ত নলকূপ এবং সেন্ট্রিফিউগাল পাম্পযুক্ত নলকূপের পানি উত্তোলনে অসুবিধা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
এদিকে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর দ্রুত নেমে যাওয়ায় জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে। যশোর শহরতলীর মুড়লী পুকুরকূল আমতলা বাসিন্দা আলী হোসেন জানান, গত ১৫ দিন ধরে তাদের পাড়ার টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। আধাঘন্টা ধরে চাপাচাপি করার পর সামান্য পানি উঠলেও তা কাজে আসে না। যেকারণে বাধ্য হয়ে পাশেই প্রতিবেশীর সাবমারসিবল পাম্পের পানি নিয়ে খাবার পানির সামাল দিচ্ছি।
একই কথা বলেন, মুড়লী মোড়ের তরিকুল ইসলাম নামে আরেক ব্যক্তি। তিনি বলেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। যাদের সামর্থ আছে তারা টিউবওয়েলের সাথে মোটর লাগিয়ে পানি তুলছে। আর যারা পারছেন না তারা এসব বাড়িতে গিয়ে পানি আনতে ধর্ণা দিচ্ছেন।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ভোগান্তি বেড়েছে বোরো আবাদে সেচ দিতে। বিশেষ করে যারা স্যালো মেশিনে সেচের কাজ করছেন তারা বিপাকে পড়েছেন। জেলার বাঘারপাড়া উপজেলার রায়পুরের কৃষক শামসুর রহমান বলেন, তাদের এলাকায় অধিকাংশ স্যালো মেশিনে পানি তুলতে কষ্ট হচ্ছে। পানি উঠলেও তার পরিমাণ কম। এর কারণে সেচ খরচ বাড়ছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, এই ক্ষেতে বোরো ধানে শীষ পরিপূর্ণতা পাচ্ছে। এ মুহূর্তে পর্যাপ্ত পানির প্রয়োজন । কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পানি কম ওঠায় দিন ও রাতের অধিকাংশ সময় স্যালোমেশিন চালাতে হচ্ছে বলে তিনি জানান।