চালের বস্তায় ৬ তথ্য বাধ্যতামূলক করলো সরকার, মানতে নারাজ চালকল মালিকরা

0

আকরামুজ্জামান ॥ পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে চালের দাম সহনশীল ও যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ শাখা থেকে চালের বস্তায় ছয়টি তথ্য লেখা বাধ্যতামূলক উল্লেখ করে যে পরিপত্র জারি করেছে তার সাথে একমত নন যশোরের চালকল মালিকরা।
রোববার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে মিল মালিকদের সাথে জেলা প্রশাসন ও খাদ্য অধিদপ্তরের এক যৌথসভায় তারা এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মিলারদের দাবি ঘোষিত পরিপত্র অনুযায়ী চাল সরবরাহ সম্ভব নয়। এতে দেশের বড় বড় কোম্পানির মালিকরা লাভবান হলেও ছোট ছোট মিল মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দুপুরে যশোর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক মো. আবরাউল হাছান মজুমদার। এ সময় সেখানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এসএম শাহীন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) সমরেন বিশ্বাস, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিত্যানন্দ কুন্ডসহ জেলার ৩১ জন অটো রাইস মিল মালিক, ৮ উপজেলার চালকল মালিক সমিতির সভাপতি, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকসহ খাদ্য বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভার শুরুতে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিত্যানন্দ কুন্ড সরকারের ঘোষিত পরিপত্র পড়ে শোনান। এ সময় তিনি উল্লেখ করেন পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে চালের দাম সহনশীল ও যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ শাখা থেকে সম্প্রতি একটি পরিপত্র জারি করেছে। যে পরিপত্রে বলা হয়েছে এখন থেকে বস্তায় উৎপাদনকারী মিলের নাম, জেলা ও উপজেলার নাম, উৎপাদনের তারিখ, মিল গেট মূল্য এবং ধান বা চালের জাত উল্লেখ করতে হবে। আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে এই নির্দেশনা কার্যকর হবে।
জারি করা এ পরিপত্রে বলা হয়েছে, সম্প্রতি দেশের চাল উৎপাদনকারী কয়েকটি জেলায় পরিদর্শন করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, বাজারে একই জাতের ধান থেকে উৎপাদিত চাল ভিন্ন ভিন্ন নামে ও দামে বিক্রি হচ্ছে। চালের দাম অযৌক্তিক পর্যায়ে গেলে বা অকস্মাৎ বৃদ্ধি পেলে মিলার, পাইকারি বিক্রেতা, খুচরো বিক্রেতা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। এতে ভোক্তাগণ ন্যায্যমূল্যে পছন্দমত জাতের ধান, চাল কিনতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ অবস্থার উত্তরণের লক্ষ্যে চালের বাজার মূল্য সহনশীল ও যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে, ধানের নামেই যাতে চাল বাজারজাতকরণ করা হয়, তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এবং এ সংক্রান্ত কার্যক্রম মনিটরিংয়ের সুবিধার্থে এ ছয় নির্দেশনা দেওয়া হয়।
পরিপত্র অনুযায়ী চালের উৎপাদনকারী মিলাররা গুদাম হতে বাণিজ্যিক কাজে চাল সরবরাহের প্রাক্কালে চালের বস্তার ওপর উৎপাদনকারী মিলের নাম, জেলা ও উপজেলার নাম, উৎপাদনের তারিখ, মিল গেট মূল্য এবং ধান/চালের জাত উল্লেখ করতে হবে। ধানের জাতের নাম, প্রস্তুতকারক, ঠিকানা (উপজেলা ও জেলা), নিট ওজন, উৎপাদনের তারিখ, মিল গেট মূল্যের এই তথ্যগুলো ছক মোতাবেক লেখা থাকবে।
বস্তার ওপর উল্লিখিত তথ্যাদি কালিতে হাত দিয়ে লেখা যাবে না। চাল উৎপাদনকারী সকল মিল মালিক (অটো/হাস্কিং) কর্তৃক সরবরাহকৃত সকল প্রকার চালের বস্তা/প্যাকেটের (৫০/২৫/১০/৫/২/১ কেজি ইত্যাদি) ওপর উল্লিখিত তথ্যাদি মুদ্রিত করতে হবে।
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশনা প্রতিপালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মিল গেট দামের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান চাইলে সর্বোচ্চ খুচরো মূল্য উল্লেখ করতে পারবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ‘খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ, বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন, ২০২৩’ এর ধারা ৬ ও ধারা ৭ মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সভায় জানানো হয়।
সভায় মিনিকেট চাল নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন মিলাররা। গবেষণা অনুযায়ী দেশে কোনো মিনিকেট জাতের চাল নেই বলা হলেও চালকল মালিকরা বস্তার ওপর মিনিকেট চালের বিভিন্ন ব্রান্ড উল্লেখ করে তা বিক্রি করেন। এটি এখন থেকে আর উল্লেখ করা যাবেনা বলে খাদ্য বিভাগের পক্ষ থেকে জানালে মিলাররা তাতে দ্বিমত পোষণ করেন। এ সময় জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, এ ধরনের বাধ্যবাধকতা বলবৎ থাকলে চালকল মালিকরা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবেন।
এ বিষয়ে নওয়াপাড়ার এ রহমান পরশ অটো রাইস মিলের মালিক আনিসুর রহমান বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চাল বিক্রির যে শর্তজুড়ে দেওয়া হচ্ছে এতে আমাদের বড় ধরনের ক্ষতি হবে। সরকার বস্তায় চালের উৎপাদনের তারিখ লিখতে বলছে। অথচ আমরা যে চাল উৎপাদন করি তা সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয় না। এছাড়া মিনিকেট চাল লেখা যাবে না বলে যে কথা বলা হচ্ছে এটি হলে এখন থেকে চাল বিক্রি করা কঠিন হবে। চাষিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ মানুষ ব্রান্ড দেখে চাল কেনে।
যশোর সদরের অ্যারিস্টো ফুড এক্সপোর্ট লিমিটেডের ডাইরেক্টর মো. মোনায়েম বলেন, পরিপত্রে ধান ও চাল সংরক্ষণের যে নির্দিষ্ট মেয়াদ দেওয়া হয়েছে তা একেবারেই সীমিত। এটি কার্যকর হলে ছোট ছোট চালকল মালিকরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন। প্রকৃত লাভবান হবেন দেশের সর্ববৃহৎ চালকল মালিকরা। তারা এ সুযোগে হাজার হাজার টন ধান কিনে তা স্টক করে চাল বানিয়ে বাজারজাত করবেন। তিনি বলেন, আমাদের এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ মিনিকেট ধানের চাষ হয়। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে মিনিকেট চাল বলতে কিছু নেই।
সভায় জেলা প্রশাসক মো. আবরাউল হাছান মজুমদার মিল মালিকদের চাল তৈরি ও তা সরবরাহের বিষয়ে সরকারের ঘোষিত পরিপত্র যথাযথ মূল্যায়নের জন্যে অনুরোধ জানান।