দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল নির্বাচনের চিত্র

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের একই চিত্র। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম ও প্রার্থীদেও ভোট বর্জনের মধ্যে দিয়ে রোববার ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হলো নির্বাচন। আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন-
খুলনা ব্যুরো জানায়, দুজন প্রার্থীর ভোট বর্জন, ভোট কেন্দ্রের সামনে থেকে ককটেল উদ্ধার, নৌকা প্রতীকের বাইরে অন্য প্রার্থীদের এজেন্ট না থাকা, নৌকা প্রতীকে প্রকাশ্যে সিল, নৌকার ভুয়া এজেন্ট আটক এবং একটি ভোটের বিনিময়ে এক প্যাকেট বিরিয়ানি প্রদানসহ বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে রোববার খুলনার ছয়টি আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।
এদিকে খুলনা-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ফাতেমা জামান সাথী এবং খুলনা-১ আসনে তৃণমূল বিএনপি’র প্রার্থী গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিকের নানা অভিযোগে ভোট বর্জন করেছেন।
অপরদিকে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার অসংখ্য বুথ ঘুরে দেখা গেছে, নৌকা প্রতীকের এজেন্ট’র বাইরে দুই/একটি কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্ট ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট নেই। এছাড়া ডুমুরিয়ার একটি কেন্দ্রে নৌকার একজন ভুয়া এজেন্টকে আটক করা হয়। এ সময় একটি ভোট কেন্দ্রের সামনে থেকে একটি তাজা ককটেল উদ্ধার করে পুলিশ।
স্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহ জানান, ঝিনাইদহের চারটি আসনের তিনটিতে নৌকা ও একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেছে বলে বেসরকারি ফলাফলে দেখা গেছে। রোববার সকালের দিকে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে ফাঁকা চিত্র দেখা যায়। বেসরকারি ফলাফলে দেখা যায়, ঝিনাইদহ-১ আসনে নৌকার প্রার্থী আব্দুল হাই এমপি ৯৫ হাজার ৬৭৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম দুলাল ট্রাক প্রতীক নিয়ে ৭৯ হাজার ৭২৮ ভোট পেয়েছেন। ঝিনাইদহ-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫৮৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার প্রার্থী তাহজীব আলম সিদ্দিকী সমি এমপি পেয়েছেন ১ লাখ ১৫ হাজার ১৫২ ভোট। ঝিনাইদহ-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী সালাহউদ্দীন মিয়াজী ৫৭ হাজার ৫৩৭ ভোট পেয়ে নৌকার নতুন মাঝি নির্বাচিত হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান সংসদ সদস্য শফিকুল আজম খান চঞ্চল ট্রাক প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৪৭ হাজার ১৭৯ ভোট। ঝিনাইদহ-৪ আসনে নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার ৯৬ হাজার ৫০৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানের ভাই আব্দুর রশিদ খোকন ট্রাক প্রতীক নিয়ে ৫৭ হাজার ১০০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন বলে প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে।
নড়াইল সংবাদদাতা জানান, অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগে নড়াইল-২ আসনে ওয়ার্কার্স পাটি ও ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছেন। রোববার নড়াইল প্রেস ক্লাবে ওয়ার্কার্স পার্টির মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট শেখ হাফিজুর রহমান এবং ইসলামী ঐক্যজোটের মিনার প্রতীকের প্রার্থী মাহবুবুর রহমান পৃথক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন বর্জন ও ফলাফল প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন। নড়াইল-১ আসনের ওয়ার্কার্স পাটির প্রার্থী অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলামও নির্বাচন বর্জন ও ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন। তারা এ নির্বাচন বাতিল করে পূনরায় নির্বাচনের দাবি জানান। এ সময় তাদের সাথে দলীয় নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
পৃথক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাফিজুর রহমান এবং মাহবুবুর রহমান বলেন,দুপুর পর্যন্ত নড়াইল-২ আসনের বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট সুষ্ঠু হলেও পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে আমাদের এজেন্টদের বের করে দিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মারা শুরু করে। আমরা স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের লোকজনের কাছে ভোট গ্রহণে অনিয়নের প্রতিকার এবং সুুষ্ঠু ভোট গ্রহণের নিশ্চয়তা চাইলেও ঘটনার কোনো প্রতিকার পাইনি। এ নির্বাচন প্রহসনের নির্বাচন। ক্ষমতাসীন দল ভোট কারচুপি করে নির্বাচনে জয়লাভ করতে সকল ধরনের অপচেষ্টা চালিয়েছে। ভোট গ্রহণে এ ধরনের অনিয়ম প্রমাণ করে, ক্ষমতাসীন সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। আমরা প্রহসনের এ নির্বাচন বর্জন ও ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলাম।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরী বলেন, তাদের অভিযোগ সত্য নয়। কয়েকটি অভিযোগ পাবার পর আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছি। সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ ও চমৎকার পরিবেশে ভোট সম্পন্ন হয়েছে বলে রিটানিং কর্মকর্তা জানান।
শার্শা (যশোর) সংবাদদাতা জানান, যশোর-১ (শার্শা) আসনের ১০২টি ভোট কেন্দ্রে সকাল ৮ থেকে ভোট শুরু হলেও বেলা ৪ টা পর্যন্ত কোনো কেন্দ্রে ভোটারের সরগম ছিল না। প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। অধিকাংশ কেন্দ্র ছিল ফাঁকা। প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে কিছু সংখ্যক নৌকা প্রতীকের নেতাকর্মী সমর্থকদের উপস্থিতি দেখা যায়। সরজমিন তদন্ত ও বিভিন্ন সূত্রে আরও জানা যায়, যশোর-১ আসনে একদলীয় ভোটে কোনো আনন্দ, উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা যায়নি। মানুষের মাঝে ছিল আতঙ্ক।
এ ব্যাপারে শার্শা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল হাসান জহির বলেন, খুলনা বিভাগীয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের নির্দেশনায় শার্শার প্রতিটি গ্রামের বিএনপি, কৃষকদল, মহিলাদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবকদল, ছাত্রদলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ সরকারের পাতানো এক দলীয় ডামি নির্বাচনে ভোট প্রদানে বিরত ছিলেন ।
তরিকুল ইসলাম, ঝিকরগাছা (যশোর) জানান, ঝিকরগাছা উপজেলার অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র ছিলো ভোটার শূন্য। এছাড়া ভোট কেন্দ্রের আশপাশে ভোটার ও জনসাধারণের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। যারা ভোট দিতে এসেছেন তারা দ্রুত ভোট দিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। ভোটের দিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত অন্তত ২৫টি কেন্দ্রে এই দৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে।
মহেশপুর (ঝিনাইদহ) সংবাদদাতা জানান, ঝিনাইদহ-৩ সংসদীয় আসনের মহেশপুরে ১১২টি ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কম ছিল। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। কিছু কিছু কেন্দ্রে ভোট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারী ব্যতিত ভোটার উপস্থিতি ছিলনা বললেই চলে।
স্টাফ রিপোর্টার, চৌগাছা (যশোর) জানান, চৌগাছার কেন্দ্রগুলোতে ভোটারের উপস্থিতি ছিল কম। সকাল ৯ টার দিকে চৌগাছা পৌর এলাকার সরকারি শাহাদৎ পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দেখা যায় খা খা করছে স্কুলের মাঠ। ভোট কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনছার সদস্যরা ঠাঁই দাড়িয়ে আছে, নেই কোন ভোটার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার ৮১টি কেন্দ্রের মধ্যে অধিকাংশ কেন্দ্রেই সকাল থেকে ছিল ভোটার শুন্য। থেমে থেমে দু একজন ভোটার ভোট দিয়ে দ্রুত কেন্দ্র ত্যাগ করেছেন। ভোটারের এমন উপস্থিতিতে খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও চরম হতাশ হয়ে পড়েছেন। উপজেলা বিএনপির আহবায়ক জহুরুল ইসলাম বলেন, সরকারের ডামি নির্বাচন চৌগাছাবাসী ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিএনপি যে আন্দোলন করছে সাধারণ মানুষ আমাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ভোট কেন্দ্রে না গিয়ে সরকারকে লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছে।
ডুমুরিয়া (খুলনা) সংবাদদাতা জানান, ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রের সামনে থেকে একটি ককটেল সাদৃশ্য বস্তু উদ্ধার করেছে পুলিশ। সকাল ৮টায় ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার সাড়ে তিন ঘণ্টা পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলার কলেজের সামনে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের পাশ থেকে এটি উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডুমুরিয়া থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ সুকান্ত সাহা।
কপিলমুনি (খুলনা) সংবাদদাতা জানান, খুলনা-৬ (পাইকগাছা-কয়রা) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী (নৌকা প্রতীক) মো. রশিদুজ্জামান মোড়ল ১,০৩,০৩১ (এক লাখ তিন হাজার একত্রিশ) ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ইঞ্জি. জিএম মাহবুবুল আলম পেয়েছেন, ৫০,২৬১ (পঞ্চাশ হাজার দুই শ একশট্টি) ভোট। এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ২ হাজার ৩১৬। দুই উপজেলার মধ্যে পাইকগাছায় রয়েছে ১০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা, এখানে ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ২৯ হাজার ৩১১ জন। অপরদিকে কয়রায় রয়েছে ৭টি ইউনিয়ন, এখানে রয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫জন ভোটার। জেলার গুরুত্বপূর্ণ এ আসনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ৬ জন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ১ জনসহ মোট ৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।