বিভিন্ন সংগঠন ও বিশিষ্টজনদের অভিমত বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে পর্যুদস্ত বাংলাদেশের মানবাধিকার

0

মাসুদ রানা বাবু ॥ আজ বিশ্ব মানাধিকার দিবস। যখন দিবসটি সারাবিশ্বে সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের মানবাধিকার পর্যুদস্ত। এখানে ভিন্নমতের মানুষের যেন বেঁচে থাকার অধিকার নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই মানবাধিকার পর্যুদস্ত করা হচ্ছে। যেখানে গণতন্ত্রের নামে চলছে একদলীয় শাসন। শাসকগোষ্ঠী আজ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিএনপির প্রতি সীমাহীন দমন, পীড়ন, নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। জনগণের বন্ধু পুলিশ নিরপেক্ষতা হারিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনুগত বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও বিশিষ্টজনেরা।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বারবার বিশ্ব গণমাধ্যমে শিরোনাম হচ্ছে । জাতিসংঘ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল,নাগরিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা সিভিকাস, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট,জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা দেশীয় মানবাধিকার ও আইনসয়তাকারী সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রেসহ (আসক),বাংলাদেশের বন্ধু প্রতীম ও বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি সরকারকে কড়া বার্তা দিচ্ছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ইউরোপসহ বিশ্বের মোট ১১০ দেশ মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতিতে ৩০১টি সুপারিশ করেছে । সেখানে বলা হয় হত্যা, গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-, দমন পীড়নে কিংবা রাজনৈতিক পেশীশক্তি মানবাধিকার পরিস্থিতিকে এক ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে নিয়ে গেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নির্বাচন, শ্রম অধিকার, ভিন্নমত দমন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহি না থাকার বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয় । মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবাধিকার পরিস্থিতির দ্রুত অবনতির জন্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি চাইতে বলা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয় ২০২৪ সালের শুরুতে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দল একের পর এক রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটানোর পাশাপাশি, বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন,নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।
ক্ষমতাসীনরা বিএনপি চেয়ারপার্সন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ শীর্ষ নেতাদের মিথ্যা মামলায় কারাবন্দী করে রেখেছে।
সাম্প্রতি যশোর জেলা যুবদলের সহ-সভপাতি আমিনুর রহমান মধু কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাকে ডান্ডাবেড়ি এবং হাতকড়া পরিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এমনকি পরিপূর্ণ চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত করা হয়। আমিনুর রহমান কলেজ শিক্ষক এবং শিক্ষক সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা। তার প্রতি অমানবিক আচরণে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালত আমলে নিয়ে তার উন্নত চিকিৎসার নির্দেশ প্রদান করেন।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবিরা নাজমুল মুন্নিকে র‌্যাব গভীর রাতে আটক করে।
এদিকে পুলিশের দায়েরকৃত তথাকথিত নাশকতা মামলায় বিএনপির নেতাকর্মীরা আদালত থেকে জামিন পেয়েও কারামুক্ত হতে পারছেন না। পুলিশ কয়েক দফায় জামিন প্রাপ্তনেতাকর্মীদের আটক করে পুনরায় কারাগারে প্রেরণ করেছে ।
চলতি মাসের প্রথম দিন রাজধানীর ওয়ারি থানার মধ্যে পুলিশি নির্যাতনে ইমতিয়াজ হাসান বুলবুল এক বিএনপি নেতা মারা যান। ২৬ অক্টোবর কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে গণগ্রেপ্তারকালে পুলিশ হেফাজতে মেহেদি হাসান সাগর ওরফে সাকবর নামের এক কৃষকদল নেতা মৃত্যুবরণ করেন। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশে পুলিশ ব্যাপক তা-ব চালায়। পুলিশের মুর্হুমুহু গুলিবর্ষণে শামীম মোল্লা নামে এক যুবদল নেতা নিহত হন। সাংবাদিকসহ দলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন। ৭ নভেম্বর কক্সবাজারে বিএনপির কর্মসূচিতে পুলিশ ও র‌্যাবের গুলিতে জাকির হোসেন নামের এক বিএনপি নেতার মৃত্যু হয়। কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় ১২ আগস্ট মো. ইদ্রিস আলী মোল্লা ও ২১ আগস্ট আবুল বাশার নামের অপর এক বিএনপি নেতা মারা যান।
গাজীপুরের গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ৩০ অক্টোবর রাসেল হাওলাদার ও ৮ নভেম্বর আঞ্জুয়ারা খাতুন (২৮) নামে এক নারী শ্রমিক নিহত হন। ২৩ নভেম্বর টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থানায় পুলিশ হেফাজতে সুমন মিয়া নামের এক ট্রাক চালকের মৃত্যু হয়।
এ বিষয় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক ( খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত একলাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মামলায় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের ৫০ লাখের বেশি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের আসামি করা হয়েছে। ছয় শতাধিক নেতাকর্মীকে গুম এবং সহস্রাধিক নেতা-কর্মী হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। এমনও অনেক নেতা আছেন, যাদের নামে রয়েছে সাড়ে চার শতাধিক মামলা। তিনি আরও বলেন, গত তিন মাসে ৩৬টি মিথ্যা মামলায় দলের শীর্ষ পর্যায়ের ৬৬৫ জন নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। গেল ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের দিন থেকে এখন পর্যন্ত দেশব্যাপী ৮৩৭ টি মিথ্যা মামলায় বিএনপির ৭৩ হাজার ১২৩ জন নেতাকর্মী ও সমর্থককে আসামি করা হয়েছে। ২০ হাজারেরও অধিক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। আট হাজারের অধিক নেতাকর্মীহামলার শিকার হয়েছেন।
বিপ্লবী কমিউনিস্ট লিগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার বলতে কিছু নেই। আছে প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন। দেশে না আছে জনগণের জীবনের নিরাপত্তা, না আছে জনগণের খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার নিরাপত্তা। আর জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোটাধিকার তো নেই। যে কারণে মানুষ পরিবর্তন চায়। এই সরকারকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। সেক্ষেত্রেও সরকার পেশীশক্তি প্রয়োগসহ, সাজানো পাতানো আরেকটি নির্বাচনের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিকে যাচ্ছে। ভিন্ন মতের রাজনীতি করার কারণে তাদেরকে মিথ্যা মামলা দিয়ে বাড়ি ঘর ছাড়া করা কিংবা দ্রুত সাজা দেওয়ার বিষয়টি কোন ভাবেই মানবাধিকারের পর্যায়ে পড়ে না।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সভাপতি অধ্যক্ষ শাহীন ইকবাল বলেন, দেশে সার্বিকভাবে যখন জনগণের মৌলিক অধিকাল ক্ষুণœ, তখন মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। দিন যতই যাচ্ছে ততই সেটি প্রকট আকার ধারণ করছে। তিনি বলেন, সুশাসন জবাবদিহিতার অভাব মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম কারণ। তাই জনগণের মানবাধিকার অক্ষুণœ রাখতে সরকারকে সর্বক্ষেত্রে সুশাসন, জবাবদিহিতা,স্বচ্চতা নিশ্চিত করতে হবে।
রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক সেটি নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। দিনে দিনে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। আজ দেশে জনগণের বাক স্বাধীনতা, মুক্ত ভাবে চলাফেরার স্বাধীনতা কোনটাই নেই। প্রতিটি সেক্টরে কেবল নীতি নৈতিকতার অবক্ষয়। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে জনগণ তার ন্যয় সঙ্গত দাবি নিয়ে কথা বলতে পারে না। ন্যূনতম প্রতিবাদের জায়গা টুকুও নেই। রাজনীতিবীদরা দেশ পরিচালনা করেন। কিন্তু আজ সেই রাজনীতিবীদদের নীতি নৈতিকতার চরম অবক্ষয় ঘটেছে। অধিকার সংক্রান্ত কোন কথা বলতে গেলেই তাকে বিভিন্ন ভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়।