দৌলতপুরে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৫ খুন

0

দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) সংবাদদাতা॥: কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা হঠাৎ করেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে উপজেলার আলাদা স্থানে ৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চিলমারীতে প্রতিপক্ষের আগুনে ২ জন, শাহাপুর এলাকায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ১ জন খুন হন। এছাড়া বৈরাগীরচর এলাকার পদ্মাপাড়ে বালিচাপা দিয়ে এক যুবককে ও সোনাইকুন্ডি গ্রামে এক প্রতিবন্ধীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকান্ডের ঘটনায় পুলিশ ২৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। একের পর এক হত্যার ঘটনায় উপজেলাজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
গত ২৭ এপ্রিল উপজেলার চিলমারী ইউনিয়নের বাজারপাড়ায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র দুইপক্ষের মধ্যে সহিংস ঘটনা ঘটে। এ সময় সেখানকার মন্ডল গ্রুপের লোকজনের ওপর হামলা ও বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় প্রতিপক্ষ শিকদার ও খাঁ গ্রুপের লোকজন। এতে ৫ জন গুরুতর দগ্ধসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। গুরুতর আহতদের মধ্যে ৫ জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুইজনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে গত ৩০ এপ্রিল সকালে চিলমারী গ্রামের তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে আকতার মন্ডল (৪০) এবং রাতে একই গ্রামের দবির মন্ডলের ছেলে দিনু মন্ডল (৬৫) মারা যান।
এই সহিংস ঘটনায় ফের নতুন করে অশান্ত হয়ে ওঠে উপজেলার বিচ্ছিন্নপ্রায় দুর্গম ইউনিয়নটি। এখনো সেখানে বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা। পুনরায় সহিংসতা এড়াতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এদিকে মঙ্গলবার সকালে চিলমারী গ্রামে নিহতদের মরদেহ নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। এতে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ অংশ নেন। তারা এ ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যা দাবি করে হামলা, ভাঙচুর ও পেট্রোল ঢেলে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার দাবি করেন।
অশান্ত চিলমারী ইউনিয়নে মঙ্গলবার সকালে যখন বিক্ষুব্ধ মানুষের বিক্ষোভ চলছিল ঠিক তখন উপজেলার হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের শাহাপুর গ্রামে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের হাতে জাকির মোল্লা (৪৫) নামে এক ব্যক্তি খুন হন। ধারালো অস্ত্র দিয়ে মুখমন্ডলসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে কোপানো কারণে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নিহতের স্বজনরা বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিপক্ষের কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন, পরিস্থিতি শান্ত করেন। নিহত জাকির মোল্লা শাহাপুর গ্রামের আরব মোল্লার ছেলে। জাকিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের ১৩টি মামলা রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
শাহাপুরে জাকির হত্যাকান্ডের রেশ না কাটতেই এদিন বিকেলে উপজেলার পদ্মারচর থেকে মারুফ হোসেন (৩৩) নামে নিখোঁজ এক যুবকের বালিচাপা দেয়া অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মঙ্গলবার বিকেল ৫টার দিকে উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের বৈরাগীরচর এলাকায় পদ্মা নদীর পাড় থেকে ওই যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত মারুফ দৌলতপুর সদর ইউনিয়নের চককৃষ্ণপুর গ্রামের হাজি আসালত মন্ডলের ছেলে। শ্বাসরোধে হত্যার পর বালির নিচে তার লাশ পুঁতে রাখা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মারুফ সপ্তাহখানেক ধরে নিখোঁজ ছিলেন। বিকেলে পদ্মার বালিচরে খেলতে গিয়ে স্থানীয় শিশুরা ওই যুবকের পুঁতে রাখা হাত ও মাথার অংশ দেখতে পায়। খবর পেয়ে দৌলতপুর থানা পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে নিহত যুবকের বিকৃত হয়ে যাওয়া অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে। এ সময় পদ্মাপাড়ে বিপুলসংখ্যক উৎসুক মানুষের ভিড় জমে। পরে পরিবারের লোকজন পরনের পোশাক দেখে মারুফকে শনাক্ত করেন। তাকে পূর্বপরিকল্পিভাবে অপহরণ করে হত্যার পর পদ্মার বালিচরে পুঁতে রাখা হয় বলে পরিবারের দাবি।
অপরদিকে এ ঘটনার কয়েকদিন আগে দৌলতপুর উপজেলার হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের সোনাইকুন্ডি গ্রামে নুরুস সালাম (৩০) নামে এক মানসিক প্রতিবন্ধীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। তিনি ওই গ্রামের শুকুর মন্ডলের ছেলে। গত ২৪ এপ্রিল নুরুস সালামকে দুর্বৃত্তরা গলা কেটে গুরুতর আহত করে সোনাইকুন্ডি উত্তরপাড়া জামিয়াতুল মাদ্রাসার পাশের রাস্তায় ফেলে রেখে যায়। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার রাতে তার মৃত্যু হয়।
এসব হত্যাকান্ডের ঘটনায় দৌলতপুর থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। বুধবার পর্যন্ত পুলিশ ২৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতরকৃতদের মধ্যে চিলমারীতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও জোড়া খুনের মামলায় ২১ জন ও অপর তিনটি খুনের মামলায় ৩ জন রয়েছেন। এদিকে হঠাৎ করেই একের পর এক হত্যাকান্ডে বর্তমানে এই উপজেলাটি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে উপজেলায় ৫টি খুনের ঘটনায় পুরো উপজেলাজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মজিবুর রহমান জানান, প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে পূর্ব বিরোধের জেরে চিলমারীতে সহিংসতা ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এ পর্যন্ত মোট ২১ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। শাহাপুরে জমিসংক্রান্ত বিরোধে জাকির হত্যায় ১ জন, পদ্মার বালিচরে হত্যার পর মারুফকে পুঁতে রাখার মামলায় ১ জন এবং সোনাইকুন্ডিতে প্রতিবন্ধী সালাম হত্যা মামলার মূল আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলাগুলোর বাকি আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিচ্ছিন্ন এসব হত্যার ঘটনায় আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।