দুর্মূল্যের খাবার যোগানে ব্যর্থ হয়ে গাভী বিক্রি করে দিচ্ছেন খামারিরা

0

শেখ আব্দুল্লাহ হুসাইন ॥ খাবারের দাম গত এক বছরে দুই গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় খামারিরা অনেকেই গাভী পালন ছেড়ে দিয়েছেন। দেশে আমিষের চাহিদা পূরণে গরুর দুধের বড় ধরনের ভূমিকা থাকলেও বর্তমানে অব্যাহত লোকসানের মুখে পড়েছে এ শিল্প। খাবারের যোগান দিতে ব্যর্থ হয়ে অনেক খামারিই গাভী বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। যশোর জেলা প্রাণিসম্পদ দফতর সূত্রে জানা যায়, গত দু বছরে জেলায় দুই হাজারেরও বেশি দুগ্ধখামার বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় খামার টিকিয়ে রাখতে এ শিল্পে সরকারের সহায়তা দানের দাবি জানান খামারিরা।
যশোর শহরের বেজপাড়ায় ‘রাবেয়া ডেইরি ফার্মের’ স্বত্বাধিকারী রওশন আরা জানান, তার খামারে বর্তমানে ২৪টি গাভী, ষাঁড় ও বাছুরসহ মোট ৩৭টি গরু আছে। খাদ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় তিনি ঠিকমত গরুর খাবার যোগান দিতে পারছেন না। আর সঠিক পরিমাণে খাবার দিতে না পারায় দুধের উৎপাদনও কম হচ্ছে। ২০০৭ সালে খামার গড়ে তোলার পর অব্যাহত লোকসানে পড়ে তিনি বাধ্য হয়ে এই প্রথম ২টি গাভী বিক্রি করেছেন এবং আরও ২টি বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজছেন। এ পর্যন্ত নানা ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে এ শিল্পকে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন বলে জানান।
শহরের খড়কির ‘তানিয়া ডেইরি ফার্মের’ স্বত্বাধিকারী মর্জিনা খাতুন জানান, গো-খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে লাগাতার লোকসানের মুখে পড়ে তার খামারের সবকটি গাভী বিক্রি করে দিয়েছেন। একই এলাকার ‘রাফসান ডেইরি ফার্মের’ স্বত্বাধিকারী মনোয়ারা বেগম ১৯৯০ সাল থেকে গাভী লালন-পালন করে আসছেন। তিনি জানান, তার খামারে ১১টি গরু ছিল। সঠিক পরিমাণে খাবার যোগান দিতে না পেরে ইতোমধ্যে ৫টি গরু বিক্রি করে দিয়েছেন। বাকি ৬টি গরুর খাবার যোগান দিয়ে যেতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।
শহরের নাজিরশংকরপুরে ‘এস এস ডেইরি ফার্মের’ স্বত্বাধিকারী শেখ শহিদুল হক বাবুর খামারে ১৬টি গাভী, ষাঁড় ও বাছুরসহ মোট ২২টি গরু রয়েছে। ২০১০ সালে তিনি গাভী লালন-পালন শুরু করেন। নানা প্রতিকূলের মধ্যে এখনও তিনি এ শিল্প টিকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু গত এক বছরে গো-খাদ্যের দাম দ্বিগুণ বাড়ায় লোকসানের মুখে পড়ে হিমশিম খাচ্ছেন।
খামারি শহিদুল হক দৈনিক লোকসমাজকে জানান, করোনা মহামারি (কোভিড-১৯) ও পরবর্তীকালে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রমাগত গো-খাদ্যের দাম বাড়তে থাকে। গাভী পালনে সুষম ও সঠিক পরিমাণে খাদ্য দেওয়া দরকার। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে তিনি ৫০ কেজি বস্তার গুঁড়ো ভুট্টা কিনেছিলেন ১১শ টাকা দিয়ে, বর্তমান দাম ২১শ টাকা। ৩৫ কেজি গমের ভুসির দাম ছিল ১৪শ টাকা, বর্তমানে ১৮শ ৫০ টাকা। ৫০ কেজি বস্তার সয়ামিল খৈল ছিল ২২শ টাকা, বর্তমানে ৩৯শ টাকা। ৩ হাজার টাকা বিচালির কাহন এখন সাড়ে ৩ হাজার টাকা। নেপিয়ার ঘাসের মণ ১শ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১শ ৮০ টাকা। ৩৫ কেজি চালের কুঁড়োর বস্তা ছিল ৩৮০ টাকা, বর্তমানে সাড়ে ৫শ টাকা। এই এক বছরে গো-খাদ্যের দাম কোনো কোনো ক্ষেত্রে দিগুণ হলেও দুধের বিক্রি দাম তেমন একটা বাড়েনি। এক বছর আগে প্রতি কেজি দুধ বিক্রি করতেন ৭০ টাকায়, সেখানে কেজিতে মাত্র ৫টাকা বেড়ে এখন বিক্রি করছেন ৭৫ টাকায়। বর্তমানে তাঁর প্রতিদিন প্রচুর লোকসান গুণতে হচ্ছে।
যশোর সদরের হামিদপুরে ‘জয়নাল ডেইরির’ শতাধিক গাভী পালনকারী জয়নাল আবেদিন জানান, গত এক বছরে গো-খাদ্যের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। লোকসানে পড়ে অনেকেই তাদের দুগ্ধখামার গুটিয়ে নিয়েছেন। দুধের উৎপাদন বৃদ্ধিতে এবং এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে প্রকৃত খামারিদের গো-খাদ্যে সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও যশোর ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী রিয়াজ মাহমুদ খান পাভেল লোকসমাজকে বলেন, গো-খাদ্যের দাম দুই গুণ বাড়ার কারণে তিনি ইতোমধ্যে তাঁর খামারের ২৯টি গাভী বিক্রি করে দিয়েছেন। খাবারের খরচ মেটাতে গিয়ে প্রতিদিন তাঁর ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছিল। তিনি বলেন, এভাবে আর কতদিন খামার টিকিয়ে রাখা যায়। এখন তাঁর খামারে মাত্র ৬টি গাভী আছে। তিনি আরও বলেন, দুগ্ধখামার কৃষিখাতের একটি অংশ হলেও বিদ্যু বিল দিতে হয় শিল্প ও বাণিজ্যিক হারে। তিনি সরকারের কাছে গো-খাদ্য কেনার জন্য প্রকৃত খামারিদের ভর্তুকি ও বিদ্যুৎ বিল কমানোর দাবি করেন।
যশোর জেলা প্রণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. রাশেদুল হক লোকসমাজকে জানান, ২০২১ সালে জেলায় দুগ্ধখামার ছিল ৫ হাজার ৫২৩টি। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে ৩ হাজার ৪৬১টি খামার রয়েছে। তবে এ কার্যক্রম এখনও চলছে। তিনি স্বীকার করেন যে, বর্তমানে বৈশি^ক কারণে গো-খাদ্যের দাম কোনও কোনও ক্ষেত্রে দ্বিগুণ বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবে খামারিরা গাভী পালনে হিমশিম খাচ্ছেন। এ সমস্যার সমাধান হিসেবে খামারিদের বেশি করে ঘাস চাষ করার পরামর্শ দেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। তিনি খামারিদের উদ্দেশ্যে বলেন, প্রাণিসম্পদ দফতর থেকে কাটিং সংগ্রহ করে খামারিরা তাদের জমি সংলগ্ন রাস্তার পাশে নেপিয়ার ঘাস লাগাতে পারেন। গাভীকে বেশি বেশি করে কাঁচা ঘাস খাওয়ালে দানাদার খাবারের ওপর চাপ কম পড়বে। সে ক্ষেত্রে গাভী পালন খরচে সাশ্রয় যেমন হবে, তেমনি দুধের উৎপাদনও বাড়বে।