চৈত্রের আগে মাঘেই নেমেছে পানির স্তর!

0

আকরামুজ্জামান ॥ সাধারণত বাংলায় ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে চৈত্র মাসে পানি সংকট তৈরি হয় দেশে। তবে এবছর মাঘ মাসের শুরুতেই যশোরের অধিকাংশ স্থানে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ৩০ থেকে ৩৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। এমনিতে এ অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ২৬ ফুটের নিচে নামলে নলকূপে পানি ওঠে না। অথচ সামনে খরা পরিস্থিতি আসার আগে এ অবস্থা দেখা দেয়ায় বড় ধরণের সংকটের আশঙ্কা জোরালো হয়ে দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাব ও অপরিকল্পিতভাবে গভীর-অগভীর নলকুপ স্থাপণের কারনে পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।
যশোর বিএডিসি (সেচ) সূত্রে জানা যায়, জেলায় গভীর নলকুপের সংখ্যা ১ হাজার ৮৬৭টি। এসব নলকূপ দিয়ে ২৫ হাজার ২২৩ হেক্টর জমিতে পানি দেওয়া হয়। অন্যদিকে স্যালো টিউবওয়েলের সংখ্যা ৬৩ হাজার ৭৯৩টি। এসব স্যালো টিউবওয়েল দিয়ে ১ লাখ ২৩ হাজার ৪৮২ হেক্টর জমিতে পানি দেওয়া হয়। এর বাইরে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, এলজিইডি, পৌরসভার আওতায় আরও কয়েক হাজার গভীর, অগভীর নলকূপসহ টিউবয়েল রয়েছে। নলকূপ ও টিউবয়েল দিয়ে জমিতে সেচ কাজের পাশাপাশি লাখ লাখ মানুষের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার হচ্ছে পানি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী যশোর জেলায় মোট অগভীর নলকূপের সংখ্যা ২৪ হাজার ৩২৩টি। অন্যান্য বছরে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যেতে থাকায় নলকূপগুলোতে মার্চ মাস থেকে ক্রমান্বয়ে পানি ওঠা বন্ধ হতে থাকে। তবে এবছর চলতি জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে জেলার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ নলকূপ দিয়ে পানি উঠছেনা। এই হিসাবে বর্তমানে যশোরে আট হাজারেরও বেশি নলকূপে পানি উঠছে না। খরা প্রলম্বিত হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহিদ পারভেজ জানান, জেলার কোথাও কোথাও ভূ-গর্ভস্থ পানি ৩০ থেকে ৩৫ ফুটের নিচে নেমে গেছে। পানির স্তর স্বাভাবিক ২৬ ফুটের নিচে নামলে নলকূপে পানি পাওয়া যায় না। বিশেষ করে যশোর সদর, বাঘারপাড়া, ঝিকরগাছা ও শার্শা এলাকায় এ অবস্থা দেখা দিয়েছে। তবে অভয়নগর উপজেলা ও মণিরামপুরে স্বাভাবিক পর্যায়ে পানির স্তর আছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, শুধুমাত্র যশোর সদরে ৫৬২৫ টি নলকূপ, সাবমার্সিবল ও তারা টিউবয়েল রয়েছে। এ উপজেলার কয়েকটি এলাকায় ৩০ থেকে ৩৫ ফুট নিচে পানির উপস্থিতি দেখা গেছে। সামনে পানির স্তর আরও নামতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন। কী কারণে এ পরিস্থিতি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে খরা মৌসুমে এমনটা দেখা দেয় এ অঞ্চলে।
অন্যদিকে যশোর শহরে পৌরসভার গভীর নলকূপ রয়েছে ২৯ টি। আর তারা পাম্প রয়েছে ৫০০ টি। এর বাইরে টিউবয়েল, সাবমর্সিবলের সংখ্যা রয়েছে প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার। কিন্তু পানির স্তর নেমে যাওয়ায় এর দুই-তৃতীয়াংশে ইতিমধ্যে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে। এখনও চালু থাকা নলকূপগুলো থেকে পানি সংগ্রহ করতে অসম্ভব শারীরিক কসরত করতে হচ্ছে মানুষকে।
পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, পৌর এলাকায় সাপ্লাই লাইনের মাধ্যমে নাগরিকদের বাসা-বাড়িতে পানি সরবরাহ করে থাকে। যশোর শহরে বর্তমানে ১০ হাজারেরও বেশি পানির গ্রাহক রয়েছে। এই সব গ্রাহকের দৈনিক পানির মোট চাহিদা ২২ লাখ গ্যালন। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে পৌর কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের কতটুকু পানির চাহিদা পূরণ করতে পারবে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে পৌর কর্র্তৃপক্ষ।
যশোর পৌরসভার সহকারী প্রকৌশল (পানি) বিএম কামাল আহম্মেদ বলেন, সাধারণত অন্যান্য বছরে ফাল্গুন মাসে এ অঞ্চলের পানির স্তর নিচে নেমে গেলেও এই প্রথম মাঘ মাসে পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নেমে গেছে। আগামী দিনের জন্য খুবই ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা রয়েছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, যশোর পৌরসভায় কতটি সাবমার্সিবল পাম্প আছে তার সঠিক সংখ্যা নিরুপনের জন্য জরিপ চলছে।
এদিকে যশোরে মাঘ মাসে যখন পানির স্তর অস্বাভাবিক ভাবে নেমে যাচ্ছে, ঠিক তখনি এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠে বোরোর আবাদের রোপন কাজ জোরে সোরে চলছে। বোরো আবাদের শুরুতে পানির ভূগর্ভস্থ স্তরের এমন অবস্থায় চাষিরা শঙ্কিত। তারা সামনে পুরো সেচ মৌসুমে পানির বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কা করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে বোরো আবাদে বড় ধরণের প্রভাব পড়বে বলে কৃষি বিভাগ মনে করছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক বলেন, চলতি মৌসুমে যশোরে ১ লক্ষ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ জমিতে ধানের চারা রোপন হয়েছে। বাকিগুলো কয়েক দিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে। তিনি বলেন, অন্যান্য বছরে বোরোর আবাদের আগে একটি বৃষ্টিপাত হলেও এবছর এখনও সেই বৃষ্টির দেখা মেলেনি। আশা করছি খুব দ্রুত বৃষ্টিপাত হলে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হবে। ফলে সেচের অভাবে বোরো আবাদের কোনো ক্ষতি হবে বলে আপাতত মনে করছিনা।