রুগ্ন ভৈরবে ধুঁকছে নওয়াপাড়া নৌবন্দর

0

নজরুল ইসলাম মল্লিক, অভয়নগর (যশোর)॥ যশোরের নওয়াপাড়া দেশের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র। হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্যের বাজার নওয়াপাড়া। আর এই নওয়াপাড়া দেশের অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে ভৈরব নদকে ঘিরে। কিন্তু যে নদকে ঘিরে এ বিশাল বাণিজ্য কেন্দ্র সেই নদই এখন ধুঁকছে রুগ্নতার যন্ত্রণায়। অব্যাহত দখল, দূষণ, অব্যবস্থাপনা ও বিআউডব্লিউটিএ’র উদাসীনতা এবং অপরিকল্পিত ব্রিজ নির্মাণের ফলে নদের বুকে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। জাগছে চর। নৌযান চলাচলের জন্যে হয়ে পড়েছে অনুপযোগী। চরে আটকে যাচ্ছে কার্গো জাহাজ। মালামাল লোড-আনলোডে দেখা দিয়েছে বিড়ম্বনা। সরু জায়গা দিয়ে কার্গো জাহাজ চলাচলে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত দশ দিনে কার্গো জাহাজের সাথে বিপরীতমুখি জাহাজের দু’টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় বন্দর ব্যবহারকারী আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা এ বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
সড়ক, রেল ও নৌপথের সুবিধায় ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় কেন্দ্রে রূপ নেয় যশোরের নওয়াপাড়া। নওয়াপাড়ার বুক চিরে বয়ে গেছে ভৈরব নদ। যশোর-খুলনা রেলপথ এবং ঢাকা-যশোর-খুলনা মহাসড়ক চলে গেছে নওয়াপাড়ার ওপর দিয়ে। এখান থেকে সারা দেশে সরবরাহ হয় কয়লা, পাথর, সার ও খাদ্যশষ্য। নওয়াপাড়া নদী বন্দর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন জাহাজ থেকে অনেক বিড়ম্বনা সামলে পণ্য নামাচ্ছেন শ্রমিকরা। নদের বেশির ভাগ অংশে পলি জমা, জাগছে চর। চরে আটকে থাকা বেশকিছু কার্গো জাহাজও দেখা গেছে। প্রায়ই কার্গো জাহাজের তলা ফেটে বড় ধরনের ক্ষতি হয় বন্দরে।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ২০১৭ সালে ভৈরব নদ খননকাজ শুরু হয়েছিল, কিন্তু কিছুদিন খনন হয় আবার বন্ধ হয় যায়।সবচেয়ে খারাপ অবস্থা নওয়াপাড়া নদী বন্দরের প্রায় সাড়ে ১২ কিলোমিটার এলাকার। ভৈরব নদের ওপর নির্মিত সেতু এলাকা দখলের কারণে আগে থেকেই নদ তার বাঁক বদলেছে। আর সেই স্থানে অপরিকল্পিত ব্রিজ নির্মাণ করায় নদের জন্যে অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। নওয়াপাড়া সার, সিমেন্ট ও খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ জালাল হোসেন বলেন, ‘অর্ধেকের মতো আমদানিকারক এই বন্দর রেখে এখন চট্টগ্রাম, মোংলায় পণ্য খালাস করছেন। আবার মাদার ভেসেল থেকে নাগরবাড়ি, গাবতলীসহ নানা বন্দরে পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবসা হারাচ্ছি। এখানে ড্রেজিং বন্ধ হয়ে যায় মাঝেমধ্যেই। জেটি, ঘাট যা-ই থাকুক, পলি জমার কারণে কার্গো কাছে আনা যায় না। আর গাইড ওয়াল না থাকায় এই সমস্যা বেশি হচ্ছে। তবে শুনেছি, নতুন করে ড্রেজিং হবে। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, নদীবন্দরে আটটি জেটি থাকলেও নদী তীর থেকে জেটি ও পল্টুন অনেক দূরে। তাই সময় ও খরচ বেড়ে যায়। যে কারণে এগুলো ব্যবহার করছেন না তারা। বন্দর কর্তৃপক্ষ ওয়্যারহাউসের সুবিধা বাড়ায়নি। নদী ভাঙন ঠেকাতে গাইড ওয়াল, পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্যে স্থায়ী সিঁড়ি ও মালবাহী ট্রাকের জন্যে পার্কিং ইয়ার্ড তৈরি করেনি। অভয়নগর-নওয়াপাড়া পৌর হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফাল্গুন মন্ডল বলেন, ‘নামমাত্র ড্রেজিং হয়। বন্দরে জাহাজের সংখ্যা দিন দিন কমছে। এমন চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে নওয়াপাড়া শুধু নামেই নৌবন্দর থাকবে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্রে জানা যায়, খুলনা থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত ভৈরবের দৈর্ঘ প্রায় ৩৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে খুলনা থেকে শিরোমণি পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটারের অবস্থা মোটামুটি ভালো। শিরোমণি থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত প্রায় ১৯ কিলোমিটার নাব্য হারিয়ে মৃতপ্রায়। নদের সাড়ে ২৭ কিলোমিটার খননের কাজ চলছে।
নওয়াপাড়া নদীবন্দর কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। ড্রেজিংয়ে কিছু সমস্যা হচ্ছে। আশপাশের সব নিচু এলাকা ভরাট হয়ে যাওয়ায় স্পয়েল ফেলার জায়গা মিলছে না। তাই ড্রেজিং ধীরগতিতে চলছে। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মেশিন আনা গেলে স্পয়েল ফেলার সুবিধা হতো।’ তিনি জানান, দখল ঠেকাতে নিয়মিত অভিযান চলছে। প্রায় ৮০টি স্থান দখলমুক্ত করা হয়েছে। এখন পাড়ে দখল নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, নওয়াপাড়া নদীবন্দর এলাকায় টার্মিনালসহ বন্দর সুবিধা নির্মাণ-সংক্রান্ত একটি প্রকল্প সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাস হয়েছে। ৪৫৪ কোটি ১৩ লাখ টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বিআউডব্লিউটিএ। এর মাধ্যমে নওয়াপাড়া পূর্ণাঙ্গ নৌবন্দর হিসেবে যাত্রা করতে পারবে বলে আশা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। প্রকল্পের সময়সীমা জুন ২০২৪ পর্যন্ত। প্রকল্পের অধীনে নিরাপদ নৌ চলাচলের জন্য প্রায় দুই লাখ ঘনমিটার খনন ছাড়াও ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে ২২ হাজার বর্গমিটার পার্কিং ইয়ার্ড, ৫৪০ বর্গমিটার বন্দর ভবন, ৭ হাজার ১৬৮ বর্গমিটার মালপত্র মজুত এলাকা এবং শ্রমিক বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন উর রশীদ বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পটি একনেকে ছাড় পেলেই বন্দর এলাকায় টার্মিনালসহ বন্দরের নানা সুবিধা বাড়বে; বিশেষ করে খননকাজ দ্রুত সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নেয়া হবে।