ফুলতলায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনিয়ম ঢাকতে ভাঙা হচ্ছে নির্মাণাধীন অংশ

0

শামসুল আলম খোকন, ফুলতলা (খুলনা)॥ মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে খুলনার ফুলতলা উপজেলার গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন ঘরে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার এবং দরপত্র বহির্ভূতভাবে তৈরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগের ভিত্তিতে কর্মকর্তাদের পরিদর্শনে অনিয়ম ধরা পড়ে। এরপর অত্যান্ত গোপনীয়তার সাথে সরকারি ছুটির দিনে নির্মাণাধীন কিছু সংখ্যক ঘরের রড ও ঢালাইয়ের কাজ করা অংশ ভেঙে ফেলা হয়। অনিয়মের দায় এড়াতে কথিত ঠিকাদার নতুন করে কিছু ঘর পুনঃনির্মাণের করার কথা বলেছেন।
উপজেলার দামোদর ও আলকা মৌজায় আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ২০২২-২৩ অর্থ বছরের ২ কোটি ৭৪ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে ২ দশমিক ৬৬ একর জমি কেনা হয়। কেনা জমিতে গৃহহীন ও ভূমিহীন ৭০টি পরিবারের আবাসনের জন্য ২ শতাংশ জমিসহ ৭০টি ঘর নির্মাণের বরাদ্দ দেয়া হয়। নকশা অনুযায়ী সাড়ে ১৯ ফুট ও ২২ ফুট ৮ ইঞ্চি আকারের দুই কক্ষ বিশিষ্ট মূল ঘরের সাথে বারান্দা, রান্না ঘর ও গোসলখান-শৌচাগার থাকছে। এর জন্য ২ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা ছাড়াও মালামাল পরিবহনের জন্য অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রকল্পে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সভাপতি, সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সদস্য এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সদস্য সচিব হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রকল্প সভাপতি কর্তৃক বোরহান ট্রেডার্সের মালিক ফুলতলার বুড়িয়ারডাঙ্গা গ্রামের শেখ বোরহান উদ্দিন নির্মাণ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। সদ্য বিদায়ী ইউএনও সাদিয়া আফরিনের তত্ত্বাবধানে গত ১ নভেম্বর ৪র্থ পর্যায়ের ঘর নির্মাণ শুরু হয়। ইতোমধ্যে ২০টি ঘরের গাথুনি ও পলেস্তারা শেষ হয়ে ১০টি ঘরের লিংটন পর্যন্ত এবং ৫টি ঘরের গ্রেডবিমের ঢালাই সম্পন্ন হয়। গত মঙ্গলবার উপজেলা নির্বাহী অফিসার খোশনূর রুবাইয়াৎ আশ্রায়ণ প্রকল্পের নির্মাণাধীন ঘর পরিদর্শনে গিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে রডের ব্যবহার দেখার উদ্দেশ্যে একটি গ্রেডবিম ভাঙতে নির্দেশ দেন। হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করতেই ঢালাই গুড়া হয়ে গ্রেডবিমের ভিতরের রড বেরিয়ে আসে। এসময় ১২ মিলির পরিবর্তে ১০ মিলি রড এবং ৬ ইঞ্চি দূরত্বের রিং আড়াই ফুট দূরত্বে গাঁথার বিষয়টি প্রকাশ পায়। ঠিক একই অবস্থা পিলার ও লিংটনে। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি নির্মাণ কাজ বন্ধের নির্দেশ দেন ওই কর্মকর্তা।
নির্মাণাধীন ঘরে নিম্নমানের ইট, খোয়া ও বালি ব্যবহার হচ্ছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১৩ নভেম্বর খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পুলক কুমার মন্ডল নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী সরেজমিনে এসে প্রত্যক্ষ করেন। গত ১৪ নভেম্বর বিকালে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোঃ শহিদুল ইসলাম ঘরের কাজের অগ্রগতি ও নির্মাণ কাজ দেখতে আসেন। নির্মাণ সামগ্রী ও কাজের ব্যপারে ওই সময়ের প্রকল্প সভাপতি ইউএনও সাদিয়া আফরিন নিম্নমানের ইটের কথাটি স্বীকার করে বলেন খারাপ ইট ফেরত দিয়ে ভালো ইট আনা হয়েছে। এ সময় কাজের মান নিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার বলেন, নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন মন্তব্য করা যাবে না।
এদিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দিনে ঠিকাদারের নিজস্ব লোকের পাহারায় গোপনীয়তার সাথে নির্মাণ শ্রমিকদের শাবল ও হাতুড়ির মাধ্যমে নির্মাণাধীন কিছু সংখ্যক ঘরের পিলার, লিংটন ও গ্রেডবিম ভাঙতে দেখা যায়। তবে ঠিকাদারের নিযুক্ত লোকের বাধার মুখে সাংবাদিকেরা ছবি না তুলেই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা মাকিদ সরদার বলেন, সঠিক তদারকির অভাবে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী এবং পরিমাণের তুলনায় কম নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে ঘরগুলো তৈরি করা হচ্ছে । আবার নির্মাণ কাজ চলার সময় আশপাশের কোন লোককে প্রকল্পের ধারে কাছে আসতে দেয়া হয় না।
প্রকল্পের সদস্য উপজেলা প্রকৌশলী ইয়াছিন আরাফাত বলেন, প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগে থেকেই ফাউন্ডেশনের ট্রেনিংয়ে বাইরে ছিলাম। যে কারণে কাজের বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। গত সপ্তাহে কর্মস্থলে যোগদান করেছি। চলতি সপ্তাহে কমিটির মিটিং এবং কাজের দেখভাল করা হবে।
প্রকল্পের সদস্য সচিব ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রকল্প সভাপতি ইউএনও সাদিয়া আফরিন কমিটির মিটিং ছাড়াই এমনকি আমাকে বাদ দিয়েই মৌখিকভাবে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি এবং ঠিকাদার মিলেই নির্মাণ সামগ্রী ক্রয়সহ সকল কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।
সাবেক ইউএনও সাদিয়া আফরিন মুঠোফোনে বলেন, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে সকল ঘর নিয়ম মাফিক ও মানসম্মত ছিল। বদলি হয়ে আসার পর নির্মাণের বিষয়টি কেমন হয়েছে আমার জানা নেই। ঠিকাদার নিয়োগের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, নির্ধারিত কমিটি যাচাই বাছাই করে মালামাল কিনেছে।
প্রকল্পের কথিত ঠিকাদার শেখ বোরহান উদ্দিন নির্মাণ কাজের অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমার অনুপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট লেবার ও মিস্ত্রীদের ভুলে কাজে সঠিক নিয়ম রক্ষা হয়নি। সে কারণে নিজের দায়িত্বে কিছু ঘরের অংশবিশেষ ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এস মৃনাল হাজরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের আশ্রায়ণ প্রকল্পের কাজে অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে সোচ্চার থাকার দাবি জানাচ্ছি।
প্রকল্প সভাপতি ও নবাগত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খোশনূর রুবাইয়াৎ বলেন, মুজিব শতবর্ষে আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পে ঠিকাদার বলে কিছুই নাই। দায়িত্ব নেয়ার পর গত বুধবার আশ্রয়াণ প্রকল্প প্রাথমিকভাবে দেখে এসেছি। রবিবার (আজ) আশ্রায়ণ প্রকল্পের সকল কাজ তদারকি করব।