ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড উপকূল ৩৩ জনের প্রাণহানি

0

 

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বাংলাদেশের উপকূলে তান্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭৫ কিলোমিটার বেগে এটি আঘাত হেনেছিল। এর প্রভাবে সারাদেশেই বৃষ্টি হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ৩৩ জনের। ঘূর্ণিঝড়টির ব্যাপ্তি ছিল ৪০০ কিলোমিটার। অন্যান্য ঘূর্ণিঝড় থেকে একেবারেই ব্যতিক্রম এটি। এটি যখন লঘুচাপ ছিল তখন থেকেই মেঘ ছাড়া শুরু করে। সবশেষ বাংলাদেশের স্থলভাগে এসে নিম্নচাপে পরিণত হয় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। এরপর এটি আরও এগিয়ে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল হয়ে শক্তি ক্ষয় করে ভারতের আসামের দিকে চলে যায়। এ কারণে সোমবার সন্ধ্যার পর খুলনা বিভাগে এর তীব্রতা কমে আসে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের মধ্যে গাছ ভেঙে পড়ে, দেয়াল ধসে এবং পানিতে ডুবে দেশের ১৬ জেলায় অন্তত ৩৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
ভারি বর্ষণ আর স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে কয়েক ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সঙ্গী করে সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম শুরু করে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’। এর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই ঝড়ো হাওয়া আর ভারী বর্ষণ শুরু হয় উপকূলের জেলাগুলোতে।
সন্ধ্যা থেকেই বিভিন্ন উপকূলীয় জেলায় গাছ ভেঙে সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর আসতে থাকে, বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে ও তার ছিঁড়ে বহু এলাকা অন্ধকারে ডুবে যায়।
এর মধ্যে ভোলা সদর, দৌলতখান, লালমোহন ও চরফ্যাশনে মারা গেছেন চারজন। কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ঝড়ো বাতাসে ঘরের ওপর গাছ পড়ে প্রাণ গেছে এক দম্পতি এবং তাদের চার বছরের শিশুর।
কক্সবাজারের টেকনাফে এক বিদেশি নাগরিক এং শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুজন করে; নড়াইলের লোহাগড়া, বরগুনা সদর, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে এবং শরীয়তপুরের জাজিরায় একজন করে মারা গেছেন ঝড়ের মধ্যে গাছ ভেঙে পড়ে।
সিরাজগঞ্জের সদরে যমুনা নদীর একটি খালে নৌকা ডুবে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে।পটুয়াখালীতে ট্রলার ডুবে মারা গেছেন এক শ্রমিক।
ঝড়ের সময় দেয়াল ধসে ঢাকার হাজারীবাগ ও গাজীপুরের কাপাসিয়ায় দুজনের প্রাণ গেছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জোয়ারের পানিতে ভেসে এসেছে এক শিশুর লাশ, যে জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল বলে পুলিশের ধারণা।
অপরদিকে, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপকূলের সন্দ্বীপ চ্যানেলে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে সেখানে থাকা আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস গণমাধ্যমে বলেন, সিত্রাং ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭৫ কিলোমিটার বেগে আমাদের উপকূলে আঘাত করে। গোপালগঞ্জে ৭৫ এবং চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কক্সবাজার, পটুয়াখালীতে বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিল ৭৪ কিলোমিটার।
কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়ে ওঠা এবং জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি থাকায় সিত্রাংয়ের কারণে যতটা ক্ষয়ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, এই ঝড়ে সেরকম কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। কারণ ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল ছিল। শুধু বৃষ্টি আর বাতাস বেশি হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে তিনি জানান, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, চট্টগ্রামের সীতাকু- এবং ভোলার কিছু বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে।
কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে, জোয়ারের পানি ঢুকেছে আর কিছু মাছের ঘেরে পানি ঢুকেছে।
‘তবে জলোচ্ছ্বাসের যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, ভাটার সময় ঘূর্ণিঝড়টা অতিক্রম করতে শুরু করায় সেই জলোচ্ছ্বাস হয়নি। ফলে উপকূলীয় এলাকায় তেমন বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি’ বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, প্রচুর বৃষ্টি ঝরিয়ে আসার কারণে স্থলভাগে উঠে আসার সময় ঝড়টি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন বিতরণ সংস্থার প্রায় দুই হাজার বৈদ্যুতিক খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি ক্ষয়ক্ষতির এই চিত্র তুলে ধরে বলেন, রাত থেকেই বিতরণ সংস্থাগুলোর কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মেরামতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
“আমাদের চার কোটি ৮০ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৮০ লাখ গ্রাহক এখনও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছেন। বিকালের মধ্যে এর ৭০ শতাংশ বিদ্যুতের আওতায় চলে আসবে বলে আশা করছি।”
ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, পল্লী বিদ্যুতের আট শতাধিক খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের খুঁটিসহ মোট ১৫০০ ধেকে ২০০০ খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে প্রায় পাঁচ ফুট জলোচ্ছ্বাস ও প্রচন্ড বেগে বাতাস বয়ে গেছে। এতে জেলা শহরসহ মেঘনা উপকূলে গাছ উপড়ে পড়ে হাজারের বেশি বসতঘর ভেঙে গেছে। জলোচ্ছ্বাসে রাস্তা ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
জোয়ারের পানিতে ২৪০টি গরু ও আটটি মহিষ ভেসে গেছে। আমন ফসল ও শীতকালীন শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কয়েকটি নৌকা ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রায় ৩৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল লক্ষ্মীপুর। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে ও প্রশাসন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এছাড়া দেশের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান।
ঝড়ের বিপদ কেটে যাওয়ার পর মঙ্গলবার দুপুরে মন্ত্রণালয়ে এক ব্রিফিংয়ে এসে তিনি বলেন, “শুকরিয়া, এটা ঘূর্ণিঝড় পর্যন্ত ছিল, কোনো সুপার সাইক্লোনে রূপান্তরিত হয়নি। বাতাসের গতিবেগ ৮০ কিলোমিটারের উপরে যায়নি।”
ঘূর্ণিঝড়টি ভোলা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপর দিয়ে বয়ে গেছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ৪১৯ ইউনিয়নের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এক হাজার মৎস্য ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
উত্তাল ঢেউয়ে লন্ডভন্ড হয়েছে কক্সবাজার সৈকত। বালিয়াড়ি ভাঙনের পাশাপাশি তছনছ হয়েছে রাস্তাঘাটও।
সৈকতের সৌন্দর্য হারিয়ে পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড়ে। এছাড়া টেকনাফের মেরিন ড্রাইভের দুই পাশের অংশে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে।
ঝড় কেটে গেলেও মঙ্গলবার সকালে সাগর উত্তাল দেখা গেছে। উত্তাল ঢেউ আঘাত হানছে বালিয়াড়ি ও জিও ব্যাগে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং পরবর্তী সৈকত দেখতে ভিড় করছেন পর্যটকরা। কিন্ত সাগর শান্ত না হওয়ায় এখনও নিষেধ রয়েছে সমুদ্রস্নান।
কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সুফিয়ান বলেন, “প্রশাসনের তৎপরতার কারণে জেলায় প্রাণহাণির কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও সেন্টমার্টিনে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে। তারপর দ্রুত ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কাজ শুরু করা হবে।”