বিশৃঙ্খলায় অনিরাপদ যশোরের সড়ক-মহাসড়ক

0

মাসুদ রানা বাবু ॥ বিশৃঙ্খলায় চরম অনিরাপদ হয়ে উঠেছে যশোরের সড়ক-মহাসড়কগুলো। এজন্য মূলত দায়ি যানবাহনের চালকদের অসচেতনতা এবং হাইওয়ে পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বহীনতা। ট্রাফিক পুলিশ দায়ি করে তাদের জনবল সংকটকে। আর সাধারণ মানুষের অভিযোগ ট্রাফিক বা হাইওয়ে পুলিশ যতটা না ব্যস্ত হালকা যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষায়, ততটাই নিস্ক্রিয় বেপরোয়া গতির যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ও মহাসড়কের যানজটসহ অন্যান্য বিশৃঙ্খলা নিরসনে।
যশোরের সড়ক-মহাসড়ক থেকে আঞ্চলিক সড়ক পর্যন্ত কোথায় নিরাপদে বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা নেই। সড়কে ওভারটেকিংয়ের নামে রয়েছে পাল্লা দিয়ে যানবাহন চালানোর প্রবণতা, ওভারলোডিং ও নিষিদ্ধ যানের নির্বিঘেœ চলাচল। এর সাথে যোগ হয়েছে উঠতি বয়সীদের বেপোয়ারা গতির মোটরসাইকেল চালানো। ফলে দীর্ঘ হচ্ছে সড়কে মৃত্যুর মিছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে যশোরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় সাত জনের, আর বর্তমান অক্টোবর মাসের এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কেননা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত অনেক মরদেহ হাসপাতাল পর্যন্ত আসে না। ঘটনাস্থল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেগুলোর খবর সংবাদপত্র পর্যন্ত আসে না।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যবর্তী জেলা যশোর। যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বের কারণে এটি এশিয়ান হাইওয়ের অন্তর্ভুক্ত। এ জেলার উপর দিয়ে যাতায়াত ১৮ রুটের পরিবহণের। জেলার চারদিকে রয়েছে চারটি মহাড়ক। এগুলো হচ্ছে যশোর-খুলনা, যশোর-মাগুরা, যশোর-বেনাপোল, যশোর-ঝিনাইদহ। এ মহাসড়ক দিয়ে একাধিক রুটের যানবাহনের চলাচল। যেমন যশোর-মাগুরা সড়ক দিয়ে চলাচল রাজধানী ঢাকা ও মাগুরাসহ রাজবাড়ী ফরিদপুরের, যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়ক দিয়ে যাতায়াত ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরের। সম্প্রতি নতুন একটি বৃহৎ রুট যোগ হয়েছে। সেটি হচ্ছে যশোর-নড়াইল সড়ক। পদ্মা ও কালনা সেতু চালু হওয়ার পর নড়াইল সড়কের গুরুত্ব বেড়েছে বহুগুণ। এছাড়া রয়েছে যশোর থেকে মণিরামপুর, কেশবপুর, রাজগগঞ্জ ও নাভারণ আঞ্চলিক সড়ক। এ সড়কগুলো আঞ্চলিক হলেও ব্যাপক ব্যস্ত। মণিরামপুর-কেশবপুর সড়ক দিয়ে যাতায়াত যশোরের উল্লিখিত ্দুই উপজেলাসহ পাশের খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায়। একই অবস্থা রাজগঞ্জ ও নাভারণ সড়কের।
বাণিজ্যেও গুরুত্বপূর্ণ যশোর। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম, বেনাপোল স্থলবন্দর, নওয়াপাড়া নৌ-বন্দর, খুলনা শিল্পাঞ্চল ও মোংলা সমুদ্রবন্দরসহ দেশের নানা প্রান্তের পণ্যবাহী পরিবহণের ব্যাপক চলাচল রয়েছে এই জেলার সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে। এছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে পণ্য আমদানি-রফতানিসহ যাত্রবাহী পরিবহণের ব্যাপক চাপ রয়েছে।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যশোর জেলার গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলো সব উল্লিখিত মহাসড়কগুলোতে অবস্থিত। যেমন- যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়কে পালবাড়ি, খয়েরতলা, সবজির বৃহৎ বাজার সাতমাইল ও চুড়ামনকাটির অবস্থান, যশোর-বেনাপোল সড়কে পুলেরহাট, ঝিকরগাছা ও ফুলের রাজধানী গদখালী বাজার, যশোর-নড়াইল সড়কে রয়েছে ঝুমঝুমপুর, হামিদপুর, দায়তলা, জামদিয়া ও চাড়াভিটা বাজার, যশোর-মাগুরা সড়কে রয়েছে হাশিমপুর, মনোহরপুর, কোদালিয়া, খাজুরা, পুলেরহাট ও সীমাখালি বাজার। এ বাজারগুলো অর্থনৈতিক ও স্থানীয়ভাবে যাতায়াতের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান। স্থানীয় বাস স্ট্যান্ডগুলো এ বাজারেই। আবার বাইরে থাকা আসা ট্রাক বাজারগুলোতে মহাড়কের উপর দাঁড়িয়ে পণ্য ওঠানো-নামানো করে। এসড়কগুলো আবার স্থানীয়ভাবে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগেরও প্রধান মাধ্যম। এ কারণে মহাসড়কগুলোতে মোটরসাইকেল, রিকসা, ভ্যান, ইজিবাইক, থ্রিহুইলারসহ ছোট ছোট নানান যানবাহন চলাচল করে। হালকা ও ক্ষুদ্র এ বাহনগুলো মহাসড়কে ভারি যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচলের ক্ষেত্রে চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এবং দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। মহাসড়কে ভারি ও হালকা যানবাহনের এ জট নিরসনে কোন ভূমিকা নেই হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশের। বেপরোয়া গতির কোন যানবাহনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার নজির নেই তাদের।
মহাসড়কের সাথে লাগোয়া প্রতিটি বাজারেই পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে সেখানে বাস-ট্রাক ও ভ্যান রাখার বা দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করা যায়। সে ব্যাপারে উদাসিন বাজার ও সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বরতরা। একারণে উল্লিখিত সড়কগুলোতে প্রতিদিন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। এ জেলার সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এটি অন্যতম কারণ।
অপরদিকে, দিনের শুরু থেকে রাত পর্যন্ত যশোর পৌর সদরের প্রতিটি সড়কে যানজট লেগে থাকলেও সেটি নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের কর্মতৎপরতা খুব বেশি চোখে পড়ে না। সকাল ৮টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত যশোর পৌর এলাকায় ১ দশমিক ৫ টনের অধিক অর্থাৎ ভারি যানবাহন চলাচল নিষেধ থাকলেও দিনের শুরু থেকে রাত পর্যন্ত তাদের অবাধ চলাচল রয়েছে। নির্মাণ সামগ্রী বোঝাই যানবাহন থেকে শুরু করে পণ্য বোঝাই বিভিন্ন ধরণের কাভার্ডভ্যানের চলাচল রয়েছে। এমনিতে দিনের শুরু থেকে রাত পর্যন্ত পৌর এলাকার সড়কগুলো রিকসা, ইজিবাইকের ধকল থাকার কারণে ব্যাপক যানজট লেগে থাকে সেখানে এই ভারি যানবাহন প্রবেশের কারণে সেই যানজটের মাত্রা বাাড়িয়ে দিচ্ছে কয়েকগুণ।
যশোর জেলা পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা মিঠু বলেন, মহাসড়কে পরিবহণ চলাচলের শৃঙ্খলা রক্ষায় হাইওয়ে পুলিশের কোন ভূমিকা নেই। একারণে সড়কে যানবাহনের যথেচ্ছ গতি, সড়কের উপর গাড়ি পার্কিং, যাত্রী ওঠানামা ইত্যাদি কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। নিরাপদ সড়ক ও দুর্ঘটনা রোধে ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশের কর্মকা-ের পদ্ধতির পরিবর্তন প্রয়োজন।
যশোরের ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করছি। আমাদের জনবল সংকটও রয়েছে। মহাড়কের নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচল বন্ধের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা একা ট্রাফিক পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা থাকতে হবে। তাছাড়া সড়কে চলাচলকারী পথচারী থেকে শুরু করে যানবাহন চালক সবাইকে সচেতন হতে হবে।
যশোরে হাইওয়ে সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আলী আহমেদ হাশমী বলেন, আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মকভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রণ করা একা আমাদের পক্ষ থেকে সম্ভব না, যতক্ষণ না পর্যন্ত চালকদের মধ্যে সচেতনতাবোধ তৈরি হবে। তাছাড়া হাইওয়ে পুলিশের ক্ষমতার পরিধি অনেক কম। আবার উঠতি বয়েসের তরুণদের পিতা- মা আবেগে পড়ে তাদের সন্তানদের মোটরসাইকেলে কিনে দেন। তারাই আবার সড়ককে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। পিতা- মায়েদেরও অনেক সচেতন হতে হবে।