প্রভাবশালী দুই ইউপি চেয়ারম্যান খুনের পর খুলনার দিঘলিয়া আতঙ্কিত জনপদে পরিণত

0

খুলনা ব্যুরো ॥ আতঙ্কিত জনপদে পরিণত হয়েছে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলা। আধিপত্য বিস্তার ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে জনপ্রতিনিধিরা হয়েছেন একে অপরের প্রতিপক্ষ। ক্ষমতাসীন দলেই গ্রুপিং সৃষ্টি হয়েছে একাধিক। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে চলছে টিকে থাকার লড়াই। বিবাদমান একাধিক গ্রুপের দ্বন্দ্বের জেরে ইতিমধ্যে খুন হয়েছেন স্থানীয় দু’জন প্রভাবশালী ইউপি চেয়ারম্যান। যার সর্বশেষ শিকার উপজেলার বারাকপুর ইউনিয়নের তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি গাজী জাকির হোসেন। এর আগে হত্যাকান্ডের শিকার হন সেনহাটি ইউনিয়নের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক গাজী আব্দুল হালিম। ফলে অন্য জনপ্রতিনিধিদের মধ্যেও বিরাজ করছে আতঙ্ক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে একটি গ্রুপ মাঠ পরিস্কারের কাজ শুরু করেছে। যে কারণে তাদের নেপথ্য ইন্ধন ও ইশারায় ‘পথের কাঁটা’ হিসেবে চিহ্নিতদের সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে একাধিক চেয়ারম্যান টার্গেটে রয়েছেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে, দিঘলিয়া উপজেলায় বহিরাগত কিলারদের পদচারণায় চরম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকেই। সম্প্রতি আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলিসহ দু’জন অস্ত্রধারী গ্রেফতার হওয়ায় আতঙ্ক আরও বেড়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। কিন্তু মেলেনি অবৈধ অস্ত্র ভান্ডারের খোঁজ। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে অপরাধীচক্রের শেল্টারদাতারা।
সূত্র মতে, গত ১২ জুন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বারাকপুর ইউনিয়নের তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি গাজী জাকির হোসেন মোটরসাইকেলযোগে উপজেলার আড়–য়া থেকে বারাকপুর ফিরছিলেন। পথে বোয়ালিয়ারচরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছালে ৮/১০ সন্ত্রাসী তার গতিরোধ করে। এ সময় তারা গাজী জাকির হোসেনকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে পার্শ্ববর্তী খালে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়। পরে এলাকাবাসী তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানী ঢাকায় নেয়া হয়। দীর্ঘ ৫০ দিন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২ আগস্ট রাত একটার দিকে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালে মারা যান তিনি। এর আগে গাজী জাকির হোসেনের ওপর হামলার ঘটনায় তার ছেলে গত ১৪ জুন গাজী আরাফাত হোসেন কাইফ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে দিঘলিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামিরা হলো-সোহেল শেখ, বারাকপুর বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আনসার শেখ, শামীম শেখ, আলমগীর মোল্লা, কামাল মল্লিক, রসুল শেখ, সালাম শেখ, আসলাম বিশ্বাস, মিকাইল শেখ ও বেল্লাল শেখ। বর্তমানে মামলার আসামিরা জামিনে রয়েছে।
সূত্র জানায়, চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেনের সাথে বারাকপুর বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আনসার শেখের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পুরনো দ্বন্দ্ব ছিল। যার অংশ হিসেবে দুটি পক্ষের মধ্যে একাধিকবার হামলা-পাল্টা হামলা এবং পাল্টা-পাল্টি মামলার ঘটনা ঘটে। বছরের পর বছর ধরে এ বিরোধ চলে আসলেও স্থানীয় ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপেও তা নিরসন হয়নি। যার সর্বশেষ পরিণতি হিসেবে জীবন দিতে হলো গাজী জাকিরকে। এর আগে ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর সেনহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গাজী আব্দুল হালিম বিকেল তিনটায় উপজেলা পরিষদ থেকে নূর গাজীর মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে গোয়ালপাড়া নামক স্থানে সন্ত্রাসীরা তার ওপর গুলিবর্ষণ করে। আহত অবস্থায় তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে পরদিন তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২ নভেম্বর রাত দুটোর দিকে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় ৩১ অক্টোবর হালিমের স্ত্রী ফারহানা হালিম দিঘলিয়া থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। পরবর্তীতে ২৩ নভেম্বর তিনি ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে একটি সম্পূরক অভিযোগ দাখিল করেন। এ মামলায় গত বছর সপ্তম দফায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হচ্ছে-গাজী মো. ইমরান হাসান ওরফে মনিরুল, মোল্লা জুলকার নাইম ওরফে মারজান আহমেদ ওরফে মুন্না (সম্প্রতি দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত), মো. ইসতিয়াক হোসেন ওরফে ইস্তি, মো. শাকিল হোসেন রানা, জাহিদ হাওলাদার, তাইজুল ইসলাম ওরফে রাজু, মারুফ হোসেন শেখ, সেলিম মল্লিক, গাজী রেজাউল ইসলাম ওরফে বাবু গাজী ও গাজী এনামুল হাসান ওরফে মাসুম, নূরুল ইসলাম গাজী ওরফে নূরু গাজী, শাহীন শেখ, গাজী মো. ইমরান হোসেন, গাজী মো. জাহিদুল ইসলাম, মানিক মোল্লা, আনিসুর রহমান, মুরাদ ওরফে গালকাটা মুরাদ, মাসুদ সরদার, মাসুদ, দিদার মোল্লা, তরিকুল ইসলাম, হুমায়ূন কবির, শেখ মনিরুল ইসলাম, মুরাদ, আব্দুল রকিব মল্লিক, মো. মনিরুল, আজগর গাজী ও শহীদুল ইসলাম শাহীন, মোল্লা আকরাম হোসেন ওরফে আকরাম মোল্লা এবং শাওনুল ইসলাম শাওন। মামলাটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
এদিকে, এ অবস্থার মধ্যেই গত ২৫ জুলাই উপজেলার দেয়াড়া এলাকার কলোনী রিনা বেগমের বাড়ি থেকে হত্যা, অস্ত্রসহ একাধিক মামলার আসামি নগরীর খানজাহান আলী থানার যোগীপোল গ্রামের সুলতান সরদারের ছেলে রাজিব হোসেন ও তার সহযোগী সেনহাটী গ্রামের রেজার মোড়ের শামসুল আলমের ছেলে ইসমাইল হোসেনকে পুলিশ আটক করে। এ সময় একটি একনলা বন্দুক, ৫ রাউন্ড গুলি, ২টি সেলাই রেঞ্জ, একটি হাতুড়ি, একটি টেস্টার, একটি রামদা, একটি বড় ছুরি ও গুলি রাখার ব্যাগ জব্দ করা হয়। আটক ইসমাইল হোসেনের স্বীকারোক্তি অনুযাযী ২৬ জুলাই সেনহাটি মদিনা মসজিদ এলাকার মানিক ফকিরের বাড়ি থেকে পুলিশ আরও একটি পিস্তল ও এক রাউন্ড গুলি জব্দ করে। এ ঘটনায় দিঘলিয়া থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। আটক দুজনকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তাদের কাছ থেকে অবৈধ অস্ত্র এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত কোন তথ্য বের করা সম্ভব হয়নি। তবে কিছু তথ্য পাওয়ার কথা স্বীকার করেন দিঘলিয়া থানা পুলিশের ওসি আহসান উল্লাহ চৌধুরী।
এ বিষয়ে সেনহাটি ইউপি চেয়ারম্যান জিয়া গাজী এ প্রতিবেদককে বলেন, একের পর এক জনপ্রিয় চেয়ারম্যান হত্যাকান্ডের ঘটনায় তিনিও চরম আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। রয়েছেন নিরাপত্তাহীনতায়। বিভিন্ন সূত্র থেকে তাকে সতর্ক এবং নিরাপদে থাকতে বলা হচ্ছে বলেও স্বীকার করেন তিনি।
গাজীরহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোল্লা মফিজুল ইসলাম ঠান্ডু বলেন, তিনিও হত্যাকারীদের টার্গেটে রয়েছেন। ইতিমধ্যে দু’বার তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আল্লাহ রক্ষা করেছেন। এ বিষয়ে থানায় জিডিও করা আছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হচ্ছে বলেও জানান তিনি।