টিপু খুন: জিজ্ঞাসাবাদে যা বলেছে শুটার মাসুম

0

শুভ্র দেব॥ মতিঝিল আওয়ামী লীগ নেতা ও কলেজশিক্ষার্থী সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যা মামলার রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে শুটার মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশ। সাতদিনের রিমান্ডের শেষ দিন ছিল আজ। আগামীকাল তাকে আদালতে হাজির করা হবে। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ধারণা করছেন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিবে শুটার মাসুম। এছাড়া মাসুমের তথ্যমতেই শামীম ও মারুফ নামের আরেকজনকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রেখেছে ডিবি পুলিশ।


ডিবি জানায়, রিমান্ডে মাসুম তাদেরকে জানিয়েছে কিলিং মিশনের অন্তত দেড় থেকে দুই মাস আগে দক্ষিণ কমলাপুরের রুপালি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (রুপালি ক্লাবে) বসে টিপুকে হত্যার মূল বৈঠক করা হয়েছিল। ওই বৈঠকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দু’জন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিকের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে নেতৃত্ব দেন দুবাইয়ে পলাতক ও বোচা বাবু হত্যা মামলার আসামি মুসা। সে ছাড়াও ওই বৈঠকে ছিলেন শামীম, মোল্লা মানিক, দামাল, মারুফসহ আরও কয়েকজন। মুসা বৈঠক শেষে শুটার ঠিক করার দায়িত্ব দেয় শামীমকে। তখন শামীমই মুসাকে মাসুমের কথা জানিয়ে বলে, ভালো একজন শুটার আছে। সে মিশন বাস্তবায়ন করতে পারবে।
রিমাণ্ডে মাসুম জানিয়েছে, রুপালি ক্লাবের ওই বৈঠকে সে উপস্থিত ছিল না। তবে বৈঠকের কিছু আলোচনা সে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শামীমের কাছ থেকে শুনেছে। ওই বৈঠকেই টিপুকে হত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারপর শামীমই তাকে জানায় বড় ভাই (মুসা) বলছে টিপুকে শেষ করে দিতে হবে। যদি টিপুকে মারতে পারে তবে তার ঝুলে থাকা মামলা নিষ্পত্তি, যাবতীয় খরচ ও পরবর্তীতে অন্যান্য সুবিধা-অসুবিধা দেখা হবে বলে জানানো হয়। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে সম্পর্ক থাকায় মাসুমের অনেক দুর্বলতার বিষয়ে শামীম জানতো। তাই এসব বিষয়কে সামনে এনে শামীম তাকে টিপু হত্যার প্রস্তাব দেয়। মাসুম এলাকায় শেয়ারে ডিশ ব্যবসা করতো। সেখান থেকে যা আসতো তা দিয়ে তার সংসার ও মামলার খরচ মেটানো সম্ভব ছিল না। মামলা ও গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কায় প্রতিনিয়ত মানসিক চাপের মধ্যে থাকতে হতো। শুধুমাত্র তার মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার প্রয়োজন ছিল। সবদিক বিবেচনা করে টিপুকে হত্যা করতে রাজি হয় মাসুম। কিলিং মিশনের আগে মাসুমকে সিএমএম কোর্টে নিয়ে যায় শামীম। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিল মুসা। পরে এক আইনজীবীর উপস্থিতিতে মাসুমের নামে থাকা ৫টি মামলা থেকে অব্যাহতি পাইয়ে দেয়ার জন্য চুক্তি হয়। কিলিং মিশন সফল হলেই মাসুমকে মামলা নিষ্পত্তির টাকা দেয়ার কথা ছিল।
রিমান্ডে মাসুম জানিয়েছে, তার বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন। ভালো পরিবারের সন্তান। পরিবারের একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল। পড়ালেখায়ও ভালো ছিল। কিন্তু বিভিন্ন ছেলেদের সঙ্গে মিশে সে বখে যায়। তবে বখে গেলেও তার মনে বাবার প্রতি দুর্বলতা ছিল। যদিও একটা সময় তার বাবার মুখোমুখি হওয়ার সাহস তার ছিল না। মাসুম জানায়, তার এক বন্ধুর মাধ্যমেই শামীমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর থেকে তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে। তারা ঘনিষ্ট বন্ধুর মতো হয়েছিল। প্রেম করে বিয়েও করেছিল মাসুম। তবে এই বিয়ে এত সহজ ছিল না। মাসুম ছিল বখে যাওয়া যুবক। আর তার প্রেমিকা ছিল ভালো পরিবারের মেয়ে। লেখাপড়ায়ও ভালো ছিল। তাই তার প্রেমিকার পরিবার সেটি মেনে নিচ্ছিল না। পরে শামীমের কারণেই তাদের বিয়ে হয়েছিল। ডিবি জানায়, শামীম স্থানীয় যুবলীগের রাজনীতি করে। ছোটখাটো কোনো পদবিতেও আছে। এলাকায় ডিশ ব্যবসাও আছে। এছাড়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিকের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। জিসানের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ মুসার। তার মাধ্যমেই জিসানের সঙ্গে যোগাযোগ হয় শামীমের। তবে শামীমের সঙ্গে ফ্রিডম মানিকের সম্পর্ক ভালো। ফ্রিডম মানিকের যাবতীয় চাঁদা উঠায় শামীম। সেখান থেকে একটি অংশ পায়। ঘটনার দিন যে মোটরসাইকেলে করে কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করেছিল মাসুম ওই মোটরসাইকেলের চালক ছিল শামীম।
ডিবি জানায়, কুরআনে হাফেজ শামীম ও মারুফকে যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা হতে পারে। ঘটনার দিন ওই স্পটে কয়টি পিস্তল ব্যবহার হয়েছে সেটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কিলিং মিশনে ব্যবহার হওয়া মোটরসাইকেলও উদ্ধার হয়নি। রিমান্ডে মাসুম জানিয়েছে সে একটি পিস্তলই ব্যবহার করেছে। অথচ ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া গুলির খোসা থেকে দুই সাইজের গুলি ব্যবহার হয়েছে বলে জানতে পেরেছে ডিবি। তবে এ নিয়ে এখনো তদন্ত চলছে। দামালকে গ্রেপ্তারের সময় তার কাছে একটি পাকিস্তানি রিভলবার পাওয়া গেছে। ঘটনার দিন সেই পিস্তলটি ব্যবহার হয়েছিল কিনা তদন্ত চলছে। কিলিং মিশনের ব্যাকআপ টিমে কেউ ছিল কিনা, থাকলে তারা গুলি করেছে কিনা বিষয়গুলো গভীরভাবে খতিয়ে দেখছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। ডিবি সূত্র জানিয়েছে, টিপু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কাজ করেছে বৃহত্তর মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, স্কুলের ভর্তি বাণিজ্য, ক্রীড়া পরিষদের টেন্ডার ও কোরবানির ঈদে গরুর হাটের নিয়ন্ত্রণ নেয়া। এক সময় পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। ক্যাসিনোকাণ্ডে সম্রাট কারাগারে যাওয়ার পর নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে মতিঝিল এলাকার সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। এ সময় সম্রাটের ঘনিষ্ঠ হিসেবে ক্ষমতা চলে আসে টিপুর কাছে। টিপু এককভাবে মতিঝিল ও আশেপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। এতে করে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ক্রীড়া পরিষদের সকল টেন্ডারও এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন টিপু। এককভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিক টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তারা ভেবেছিল টিপু পথের কাটা। তাকে সরিয়ে দিলে আর কোনো বাধা নেই। এছাড়া বোচা বাবু হত্যার পর থেকেও টিপুর উপরে এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুসারীদের ক্ষোভ বাড়ে।
ডিবির কর্মকর্তারা জানান, আন্ডারওয়ার্ল্ড গডফাদারদের নির্দেশে টিপুকে হত্যার মিশন সফল করতে সব ধরনের সমন্বয় করে মুসা। এই মুসার সঙ্গে আবার টিপুর দীর্ঘদিনের রেশারেশি চলছিল। কারণ বোচা বাবু হত্যা মামলার সব ধরনের খরচ চালাতেন টিপু। বোচা বাবুর বাবা আবুল কালামও টিপুর ঘনিষ্ঠ লোক। হত্যাকাণ্ডের সময় টিপুর গাড়ির পেছনেও বসা ছিলেন তিনি। বোচা বাবু হত্যা মামলার আরেক আসামি ফারুকেরও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে এ হত্যাকাণ্ডে। কানা ফারুক একবার ২ কোটি টাকার টেন্ডার পেয়ে সেই কাজের ৩০ লাখ টাকা নিয়ে টিপুর কাছে যায়। কিন্তু টিপু মীমাংসা করতে রাজি হননি। বোচা বাবুর বাবা আবুল কালাম টিপুর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় টিপু ভেবেছিলেন একমাত্র ছেলে বোচা বাবু হত্যার বিচার অন্তত পাক আবুল কালাম। পাশাপাশি যুবলীগ নেতা মিল্কি হত্যার রেশও টিপু হত্যাকাণ্ডে ভূমিকা রেখেছে। বোচা বাবু হত্যার আসামি কানা ফারুক ও কাইল্লা পলাশ ছিলেন মিল্কি হত্যা মামলার বাদীপক্ষের লোক। মিল্কি হত্যার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে তারা টিপুসহ বেশ কয়েকজনকে সন্দেহ করতেন। টিপু ওই মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় তাদের ক্ষোভ জন্ম নেয়। মূলত পথের কাটা সরাতে আন্ডারওয়ার্ল্ড গডফাদাররা বোচা বাবু ও মিল্কি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় টিপুর প্রতি বিক্ষুব্ধ গ্রুপটিকে ব্যবহার করেছে। আলোচিত টিপু হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি পুলিশ ও র‌্যাব। এদের মধ্যে ডিবির হাতে গ্রেপ্তার শুটার মাসুম ছাড়াও রুপালি ক্লাবের দামাল রয়েছে। দামালকে গ্রেপ্তার করে ১ দিনের রিমান্ড পেয়েছিল ডিবি। এছাড়া র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে ৪ জনকে। তারা হলো- ওমর ফারুক, শুটার সালেহ, কিলার নাছির, কাইল্লা পলাশ। এই ৪ জনকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ডিবি। গতকাল থেকে তাদের রিমান্ড শুরু হয়েছে। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, শুটার মাসুমের ৭ দিনের রিমান্ড শেষ হয়েছে। তাকে আদালতে তোলা হবে। আশা করছি কোর্টে তার জবানবন্দি দিবে। রিমান্ডে সে চাঞ্চল্যকর বেশকিছু তথ্য দিয়েছে। সেই তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করছি। মাসুমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শামীমকে আমরা নজরদারিতে রেখেছি। তাকে গ্রেপ্তার করলে আরও অনেক তথ্য বের হবে। ডিবি মতিঝিলের উপ পুলিশ কমিশনার রিফাত রহমান শামীম বলেন, টিপু হত্যার তদন্তে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। বেশকিছু তথ্য পেয়েছি। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার ৪ জনকে ৫ দিনের রিমান্ডে এনেছি। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।