গ্যাসের আনুপাতিক হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব

0

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ॥ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের উপর গণশুনানি শেষ। আগামী ৯০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত দিবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আর এই গ্যাসের দাম বাড়লে আনুপাতিক হারে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। গ্যাস সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় গত অর্থবছর রেকর্ড লোকসান গুনে পিডিবি। চলতি অর্থবছরও বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে। এতে দেশেও বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। ফলে চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে লোকসান আরও বৃদ্ধি পাবে। আর সে ঘাটতি পূরণে বাড়াতে হবে ভর্তুকি। এ চাপ কমাতে এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এদিকে আজ সচিবালয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ পাওয়া নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সবাই যেন প্রস্তুত থাকে, হয় শকড আসবে, না হয় আসবে না। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন, সেটি কোন পর্যায়ে আছে এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগামী দিনগুলোতে যে চ্যালেঞ্জ আসছে, তা মোকাবিলার জন্য যে পরিমাণ ধৈর্য দরকার, তা সবার কাছে আশা করি। দাম বাড়বে কিনা সেটা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বলতে পারবে। প্রস্তাব গেছে, সেটা বিইআরসি’র সিদ্ধান্ত। তবে আমরা চাচ্ছি যতটুকু সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়। সমপ্রতি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) বিদ্যুতের পাইকারি (বাল্ক) মূল্যহার বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি। এতে তিন ধরনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রথম প্রস্তাবে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার প্রায় ৬৯ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিকে সরকার গ্যাসের দামও বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে বিইআরসি শুনানি শেষ করেছে। তা কার্যকর হলে বিদ্যুতের মূল্যহার আনুপাতিক হারে আরও বৃদ্ধির জন্য দুটি বিকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ডিমান্ড চার্জ আরোপ, ২০২৩-২০২৫ সালের জন্য ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ ট্যারিফ নির্ধারণ, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা ইত্যাদি বিষয়ও তুলে ধরা হয়েছে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ও বিদ্যুৎ খাতের জন্য বরাদ্দকৃত এক হাজার ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে না পারায় ফার্নেস অয়েল আমদানি বাড়াতে হয়েছে। তবে গত জুনে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে এ বাবদ ব্যয় ৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে গত অর্থবছর শুধু জ্বালানি বাবদ ব্যয় আট হাজার ১৮০ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ২০২০-২১ অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় দাঁড়িয়েছে তিন টাকা ১৬ পয়সা। ২০১৯-২০ অর্থবছর এ ব্যয় ছিল ২ টাকা ১৩ পয়সা। এদিকে জুলাইয়ে কয়লার ওপর পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও কয়লার দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব ধরনের জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি ও গ্যাস সরবরাহ আরও কমে যাওয়ায় চলতি (২০২২) বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিট জ্বালানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ৪ টাকা ২৪ পয়সা। আর জ্বালানি বাবদ মোট ব্যয় বাড়বে ১২ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা। তবে এতে গ্যাসের সম্ভাব্য মূল্য বৃদ্ধি বিবেচনা করলে এ ব্যয় আরও বাড়বে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিইআরসি বিদ্যুতের গড় বাল্কমূল্য নির্ধারণ করে পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা। যদিও গত অর্থবছর গড় বাল্ক বিক্রয় মূল্য পাঁচ টাকা ১২ পয়সায় নেমে যায়। এতে পিডিবি’র বিদ্যুৎ বাল্ক বিক্রয় থেকে আয় হয় ৩৯ হাজার ৫২ কোটি টাকা। আর এ বিদ্যুৎ কেনায় পিডিবি’র ব্যয় হয় ৫০ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। এতে সংস্থাটির লোকসান তথা ঘাটতি দাঁড়ায় ১১ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার ১১ মাসের জন্য (জুলাই-মে) ভর্তুকি দিয়েছে ১০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ভর্তুকি পাওয়ার অপেক্ষায় আছে পিডিবি।
বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রির ফলে চলতি বছর পিডিবি’র ঘাটতি দাঁড়াবে ৩০ হাজার ২৫২ কোটি টাকা। এ ঘাটতি মেটাতে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার ইউনিটপ্রতি নির্ধারণ করতে হবে আট টাকা ৫৮ পয়সা। অর্থাৎ বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার সাড়ে তিন টাকা বা ৬৮ দশমিক ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে। আর বাল্ক মূল্যহার বৃদ্ধির অনুপাতে গ্রাহক পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিকল্প প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে গ্যাসের দাম ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি করলে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি আরও ৫৬ পয়সা বাড়াতে হবে। এতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার পড়বে ৯ টাকা ১৪ পয়সা। আর গ্যাসের দাম ১২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করলে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে আরও ৬৯ পয়সা বাড়াতে হবে। এতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার পড়বে ৯ টাকা ২৭ পয়সা। বাল্ক মূল্যহার বৃদ্ধির পাশাপাশি ট্যারিফ নির্ধারণে ডিমান্ড চার্জ আরোপের প্রস্তাব করেছে পিডিবি। এ ছাড়া ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের জন্য ট্যারিফ ঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধির পৃথক প্রস্তাবও রয়েছে এতে। তা না হলে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিইআরসিকে মাল্টি-ইয়ার ট্যারিফ ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যাপটিভ নিরুৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বিইআরসিকে অনুরোধ করা হয়।