‘ফাঁসি কার্যকর হলে আত্মা শান্তি পাবে’

0

মামুন খান॥ ১১ বছর আগে শবে বরাতের রাতে (২০১১ সালের ১৭ জুলাই ) সাভারের আমিন বাজারে ছয় ছাত্রকে ডাকাত সন্দেহে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বিচারিক আদালত ১৩ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এখন নিহত ৬ ছাত্রের পরিবার তাকিয়ে আছে, উচ্চ আদালতের দিকে। তাদের আশা, ‘উচ্চ আদালতে এ রায় বহাল থাকবে। আর ফাঁসির আসামিদের রায় কার্যকর হলে আত্মা শান্তি পাবে।’ নিহতরা হলেন-ধানমন্ডির ম্যাপললিফের এ লেভেলের ছাত্র শামস রহিম, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম খলিল, বাঙলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশ, তেজগাঁও কলেজের ব্যবস্থাপনা প্রথম বর্ষের ছাত্র টিপু সুলতান, মিরপুরের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সিতাব জাবীর মুনিব এবং বাঙলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র কামরুজ্জামান কান্ত। তাদের সঙ্গে থাকা বন্ধু আল-আমিন গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান।
টিপু সুলতানের মা কাজী নাজমা সুলতানা বলেন, ‘১১ বছর হয়ে গেলো ৬ টা ছেলেক নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করার। আদালত ১৩ জনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন। ১৯ জনকে দিয়েছেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আশা করছি, উচ্চ আদালতে আসামিদের সাজা বহাল থাকবে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা কার্যকর হবে। আসামিদের ফাঁসি হলে আত্মা শান্তি পাবে।’ অ্যাডভোকেট আনিসুল হক চন্দনের ছেলে শামস রহিম। আশায় ছিলেন, ছেলে হত্যার বিচার দেখে যাবেন। কিন্তু ৬ মাস আগে তিনি মারা যান। দেখে যেতে পারেননি ছেলের হত্যাকারীদের বিচার। এ বিষয়ে আনিসুল হক চন্দনের স্ত্রী বলেন, ‘নিম্ন আদালতের কার্যক্রম শেষ হয়েছে। নথি উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য আছে। এখন আমাদের প্রত্যাশা রায়টা যেন কার্যকর হয়। হত্যাকাণ্ডের অনেক দিন হয়ে গেছে। শুধু রায় হলে তো হবে, তা কার্যকর করতে হবে। এত দেরি করলে মানুষ তা মনে রাখে না। আমি মনে করি, মামলা ডিলে হলে ডিভেট হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘রায়ে ১৩ জনের ফাঁসি, ১৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২৫ জন খালাস পেয়েছেন। ওদেরও সাজা হওয়া দরকার ছিল। এটা একটা নির্মম হত্যাকাণ্ড। ওর বাবার ইচ্ছে ছিল রায় দেখে যাওয়ার। কিন্তু তা আর পারলেন না। ৬ মাস আগে হলে হয়তো রায় দেখে যেতে পারতেন। রায় হলো, তবে বাপ মরে যাওয়ার পর।’
কান্তর বাবা আব্দুল কাদের সুরুজ বলেন,‘পৃথিবী দিয়ে দিলেও ছেলেকে পাবো না। প্রথম থেকে আমার একটাই উদ্দেশ্যে ছিল, কিভাবে ছেলের ওপর দেয়া ডাকাতের মিথ্যা অপবাদ প্রমাণ করা যায়। সেটা প্রমাণিত হয়েছে যে ওরা ডাকাত ছিল না। দেশবাসী জেনেছে ওরা ডাকাত না। যে গ্রামে ঘটনা ঘটেছে, সেই এলাকার পুরো মানুষকে ফাঁসি দিলেও আমার ছেলে ফিরে আসবে না। আসামিদের ফাঁসি, যাবজ্জীবান কারাদণ্ড হয়েছে। এখন তারা জেল থেকে বের হলেও আমার দুঃখ নেই। আমার যা পাওয়ার আমি পেয়েছি। এখন ওদের ফাঁসি দিলে, ওরা তো কারো না কারো সন্তান, ভাই। আরও মায়ের বুক খালি হবে।’
২ ডিসেম্বর ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ইসমত জাহান এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১৩ আসামি হলেন-আবদুল মালেক, সাইদ মেম্বার, আবদুর রশীদ, ইসমাইল হোসেন, জমশের আলী, মীর হোসেন, মজিবর রহমান, আনোয়ার হোসেন, রজ্জব আলী সোহাগ, আলম, রানা, আবদুল হামিদ ও আসলাম মিয়া। এদের মধ্যে জমশের আলী গত ১৪ মার্চ কাশিমপুর কারাহাসপাতালে মারা যান। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ আসামি হলেন-শাহীন আহমেদ, ফরিদ খান, রাজীব হোসেন, ওয়াসিম, সাত্তার, সেলিম, মনির হোসেন, আলমগীর, মোবারক হোসেন, অখিল খন্দকার, বশির, রুবেল, নুর ইসলাম, শাহাদত হোসেন, টুটুল, মাসুদ, মোকলেছ, তোতন ও সাইফুল। মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ৩২ আসামিকে আলামত নষ্টের দায়ে সাত বছরের কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ৬ মাস তাদের কারাভোগ করতে হবে। ২৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তারা খালাস পান।
ঘোষিত ওই রায়ে বিচারক বলেন, ‘একজন প্রকৃত দাগী অপরাধীরও আইনের আশ্রয় লাভের সুযোগ রয়েছে এবং আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া তাকে হত্যা করার কোন অধিকার সাধারণ মানুষকে দেওয়া হয়নি। সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এবং বিচারের নিয়ন্ত্রণের ভারসাম্য রক্ষার জন্য আদালত ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। কিন্তু এদের পাশ কাটিয়ে স্বেচ্ছাচারীর মত আইনকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই আসামিরা নির্মমভাবে ডিসিসডদের হত্যা করেছে। মৃত ব্যক্তির কখনোই কোন বক্তব্য পেশ করার বা আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোন সুযোগ পায় না। হতভাগ্য ৬ ছাত্র সেদিন শবে বরাতের রাত্রে ৩২ জন আসামির হাতে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হয়েছে। একই সাথে তাদেরকে এবং তাদের হতভাগ্য পরিবারকে মিথ্যা ডাকাতির কলঙ্ক মাথায় নিয়ে সমাজে চলতে হয়েছে। তাই আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া উচিত বলে আদালত মনে করেন।’ মামলাটি উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় আছে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ৬ ছাত্রকে হত্যার ঘটনার পর ডাকাতির অভিযোগে আল-আমিনসহ নিহতদের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় একটি ডাকাতির মামলা করেন স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী আবদুল মালেক। এছাড়া পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা গ্রামবাসীকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় আরেকটি মামলা করে। ২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারি র‌্যাব কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন আহমেদ ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। একই বছরে ৬০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এছাড়া ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একমাত্র ভিকটিম আল-আমিনকে একই ঘটনায় করা ডাকাতি মামলা থেকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়।