ঝিকরগাছার অদম্য নারী বিধবা বন্দনা রায়

0

তরিকুল ইসলাম, ঝিকরগাছা (যশোর)॥ কন্যাসন্তান যে বোঝা নয় বরং বাবা মায়ের আশীর্বাদ তা সমাজের চোঁখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন অদম্য নারী বন্দনা রায় (৫৫)। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি তার তিনকন্যা সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। তিনি একজন সাহসী নারী ও গর্বিত ‘মা। ’’বলছিলাম’’ যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা পৌরসদর কৃষ্ণনগর গ্রামের বাসিন্দা পরলোকগত নিশিকান্ত রায় ওরফে নিশির স্ত্রী বিধবা বন্দনা রায়ের কথা। ছোট্ট একটি মিষ্টান্ন্যের (হোটেল) দোকান চালিয়ে সংসার নির্বাহের পাশাপাশি লিপিকা রায়, সাগরিকা রায় ও ইতিকা রায়কে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। জানাগেছে, তার বড় মেয়ে লিপিকা রায় গণিত বিষয়ে মাস্টার্স পাশ, মেজো মেয়ে সাগরিকা রায় রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস ডাক্তার পাশ করেছেন ও ছোট মেয়ে ইতিকা রায় ঢাকার একটি বেসরকারি মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় থেকে বি.ফার্মা শেষ বর্ষে অধ্যায়নরত। বড় ও মেজো মেয়ে বিবাহিত। বড় জামাতা ব্যাংকার ও মেজো জামাতা এমবিবিএস ডাক্তার বলে জানালেন বন্দনা রায়। ছোট মেয়ে ইতিকা রায়কে নিয়ে এখনও দুশ্চিন্তার ঘোর কাটেনি তার। শিক্ষিত সুপাত্রের হাতে তুলে দিতে পারলেই নিজেকে পরম সুখি মানুষ মনে করবেন বলে আকাঙ্খার কথা জানান তিনি। প্রয়াত নিশিকান্ত রায় ২০১৮ সালে অকালে পরলোকগত হন। মৃত্যুকালে তিনি বিভিন্ন শ্রেণিতে পড়–য়া এক শিশু ও দুই কিশোরী কন্যা রেখে যান। স্বামীর অকাল ও আকস্মিক মৃত্যুতে হতবিহবল ও দিশেহারা হয়ে পড়েন গৃহিণী বন্দনা রায়। তিনি আক্ষেপের সাথে বলেন, স্বামীর অন্তেষ্ট্রিক্রিয়া সম্পন্নের পর পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনেরা শান্তনার বাণী শুনিয়েছিলেন মাত্র। নিজেকে এসময় ‘জীবন নদীর’ মাঝ দরিয়ায় তরী ডোবার মতো মানসিক দূরাবস্থায় পড়ি। ভাবছিলাম, সংসার নির্বাহের পাশাপাশি মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নিবো কিভাবে। শেষপর্যন্ত স্বামীর রেখে যাওয়া ঝিকরগাছা পানবাজারের ভেতরে ’’নিশি হোটেলটি’’ নিজেই পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিই। শুরু হয় তার সংসার জীবনের এক নতুন অধ্যায়। সাহস আর দৃঢ়মনোবলে দোকান চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। প্রথমদিকে বেচাঁকেনা তেমন ভালো হতো না। মানুষের সাথে বিনয়ী ও আন্তরিক হওয়ায় অল্প দিনেই ক্রেতাসাধারণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন । সেকারনে ক্রেতারাও তার প্রতি সদয় ও সহযোগীতামূলক ব্যবহার করেছেন বলে জানান বন্ধনা রায়। বন্ধনা রায় বলেন, স্বামী নিশিকান্ত রায় সাড়েচার শতাংশের উপর বসতবাড়ি আর দোকানটুকু ছাড়া কোন ব্যাংক-ব্যালেন্স কিংবা নগদ টাকা পয়সা রেখে যেতে পারেননি। সংসার জীবনের এই চরম সংকটকালের মুহূর্তে অর্ধাহারে-অনাহারে কাটালেও তিন মেয়ের লেখাপড়া ব্যাহত হতে দেয়নি। ভরণপোষণেও বাবার অভাব কখনও বুঝতে দেয়নি। এখনও আমি নিজেকে একজন সুখি মানুষ ভাবতে পারিনা। কিছুটা আক্ষেপের সুরে বন্দনা বলেন, করোনাকালীন সময়ে লকডাউনে সরকারি বিধি নিষেধ থাকায় ঠিকমতো দোকান চালাতে পারিনি। ফলে, ক্রমাগত লোকসান হওয়ায় দায়দেনাগ্রস্থ হয়ে পড়ি। তার ধকল এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সরকারি কোন প্রণদনা কিংবা ক্ষতিপূরণও পাননি। তিনি বলেন, তার চাকরী প্রত্যাশি বড় মেয়ে লিপিকা রায় বর্তমানে নিজবাড়িতে জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির কেক তৈরির অর্ডার ও সরবরাহ করে থাকেন। এতে, তার কিছুটা আয়-রোজগারও হয়। নিজেও একজন উপাদেয় মিষ্টান্ন্য তৈরির সুদক্ষ কারিগর বন্দনা রায়। তার দোকানে নিয়মিত ৬/৭জন শ্রমিক কাজ করেন। প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা তাদের পারিশ্রমিক দিতে হয় বলে জানান তিনি। বন্দনা রায়ের মতে, জীবনে যত বিপদ আসুকনা কেন মনোবল না হারিয়ে সাহসীকতার পথ কখনো কন্টকাকীর্ণ হতে পরেনা। কন্যা সন্তান যদি শিক্ষিত হয় সেও পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে গূরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলেও জানিয়েছেন অদম্য নারী বন্দনা রায়।