নির্বাচন কমিশন ও মতলব আলী সরকার

0

শহীদুল্লাহ ফরায়জী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে এখন কোন নির্বাচন কমিশন নেই। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে শূন্য হয়েছে। রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকতে পারেন, কিন্তু নির্বাচন কমিশন মেয়াদ অবসানে স্বীয় পদে বহাল থাকতে পারেন না বিধায় নির্বাচন কমিশন শূন্য হয়েছে। কোন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি,যুদ্ধাবস্থা বা জরুরি অবস্থা ছাড়াই সরকার নির্বাচন কমিশন নিয়োগে কালক্ষেপণের অজুহাত সৃষ্টি করেছে যা আইনগত বা নৈতিক ভাবে সমর্থন যোগ্য নয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বিচারপতি এম ইদ্রিস দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইতিহাসের পাতায় স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১২টি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে বাংলাদেশে৷ কয়েকটি কমিশন পূর্ণ মেয়াদ সম্পন্ন করতে পারেনি। অন্যদিকে বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম কমিশন আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান সরকার অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনের ধারাবাহিকতা সংরক্ষণের সাংবিধানিক দায়িত্ব ও নৈতিক কর্তব্য পালন করেনি, ফলে নির্বাচন কমিশন বিহীন রাষ্ট্র চলছে গত কয়েকদিন ধরে। এসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে সংবিধানের বিধি-বিধান কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ সংবিধানের প্রতি কতটুকু আনুগত্যশীল তা প্রমাণিত হয়েছে ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে। সংবিধানের প্রতি সরকারের উদাসীনতা, অমনোযোগিতা এবং অশ্রদ্ধার কারণে নির্বাচন কমিশনের ধারাবাহিকতা ক্ষুন্ন হয়েছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রতিটি রাষ্ট্রে কিছু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানেও এমন কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যা সাংবিধানিক উপায়ে প্রতিষ্ঠিত। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ পদ্ধতি, পদের মেয়াদ, পদত্যাগ ও অপসারণ পদ্ধতি, পদমর্যাদা ও গুরুত্ব এবং কার্যাবলী সংবিধানে সুনির্দিষ্ট ও সুষ্ঠুভাবে উল্লেখ রয়েছে।
যেসব প্রতিষ্ঠান সংবিধানের সুস্পষ্ট বিধি মোতাবেক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয় তাকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বলে। বাংলাদেশের সংবিধানের অধীনেও কয়েকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে: ১. নির্বাচন কমিশন, ২. অ্যাটর্নি- জেনারেল, ৩. মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, এবং ৪. সরকারি কর্ম কমিশন। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশন একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সংবিধানের সপ্তম ভাগে ১১৮ থেকে ১২৬ নং অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।
সংবিধানের ১১৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে কোন নির্বাচন কমিশনারের পদের মেয়াদ কার্যভার গ্রহণের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসরকাল হইবে ।
বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ কবে শেষ হবে তা জানার পরও যথাসময়ে ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন গঠনে উদ্যোগ গ্রহণ না করার সরকারের সাংবিধানিক চেতনা কোনক্রমেই ন্যায়সঙ্গত নয়। কারণ, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের ইচ্ছাধীন নয়, সংবিধানের ইচ্ছাধীন। আইনমন্ত্রী বলেছিলেন সময়ের অভাবে নির্বাচন কমিশন আইন করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ ১২তম কমিশনের মেয়াদ অবসানের পূর্বে ত্রয়োদশ কমিশন গঠন সম্ভব হবে না। মেয়াদ অবসানের পর এখন আবার আইনমন্ত্রী নতুন করে বলছেন সাংবিধানিক শূন্যতা হবে না। আবার সরকার প্রধান আগে থেকেই এই আইনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন বলে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু যথাসময়ে নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ না করেও সরকার এখন বাহবা কুঁড়াতে চাচ্ছে। সুযোগ- সুবিধার চোখে সংবিধানকে ব্যাখ্যা ও ব্যবহার করার সরকারের প্রবণতা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে স্বীয় রাজনৈতিক স্বার্থে নির্বাচন কমিশন নিয়োগে বিলম্বের আশ্রয় নিয়েছে। এক নাগাদ ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় বর্তমান সরকার, কিন্তু মেয়াদ অবসানের পূর্বে কমিশন গঠন করতে হবে এ ধারণা সরকারের ছিল না, এটা বিশ্বাস করলে সরকারের প্রতি প্রচণ্ড অবিচার করা হবে। এমনিতেই বিগত দুটি নির্বাচন কমিশন নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এবং গণতন্ত্রকে কফিনে রেখে বিদায় নিয়েছে। সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।’
কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, তাঁরা স্বাধীন না থেকে সরকারের মুখাপেক্ষী হয়েছেন এবং কার্যত আইন ও সংবিধান লংঘন করে সরকারের উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের আইনি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হচ্ছে যৌগিক। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গ্রহণ করা হয়। ফলে বিবেক তাড়িত মাহবুব তালুকদার সংখ্যালঘু হওয়ায় প্রতিবাদী হয়েও অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারেননি। কিন্তু তিনি জাতির মননে ‘সত্যের নৈতিক মশাল’ জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন। বর্তমানে জাতীয় ঐকমত্যবিহীন যে প্রক্রিয়ায় ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন গঠিত হচ্ছে তাতে হয়তো আর মাহবুব তালুকদার এর মতো কারো সংখ্যালঘু হওয়ার সুযোগও থাকবেনা। হুদা কমিশন অসাংবিধানিক পন্থায় সংবিধানের বিধানের প্রতি নাগরিক আস্থা, বিশ্বাস ও প্রত্যয় পরাহত করেছেন। সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদে শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অসাংবিধানিক পন্থায় এই ধরনের উদ্যোগ বা ষড়যন্ত্রকে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে দোষী হবে বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু হুদা কমিশন সরকারের অনুগ্রহভাজন হওয়ায় তাঁরা বিনা বিচারে নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের এই দেশে ভোটাধিকার, নির্বাচন এবং সংবিধান ধ্বংসস্তূপে পরিণত করলেও কোন বিচারের সম্মুখীন হতে হচ্ছে না তা এখন প্রমাণিত। সংবিধান লংঘনের এসব কলঙ্কজনক দৃষ্টান্ত ভবিষ্যতে বড় ধরনের অভিশাপ ডেকে আনবে। অন্যদিকে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ কিন্তু বর্তমান সরকার নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব পালনে সহায়তা না করে অপকৌশলে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে প্রশাসনসহ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ন্যাক্কারজনকভাবে ব্যবহার করে রাতের আঁধারে বেআইনিভাবে ভোট সম্পন্ন করেছে। সরকার যদি আগামী সংসদ নির্বাচনেও অনুরূপ ভূমিকা গ্রহণ করে তাহলে ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন ‘দেবতার’ দ্বারা গঠিত হলেও জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এক সময় দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করতো, দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কোনভাবেই সম্ভব নয়। বিচারপতি কে এম হাসান অতীতে কোনো একদিন বিএনপির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন (কোন নেতৃত্বে নয়) – শুধু এই কারণে তাঁর অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যায় না বলে আওয়ামী লীগ পণ করেছিলো। অথচ এখন দলীয় সভাপতি, একই সাথে সরকারেরও প্রধান, তবুও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যায় বলে আওয়ামী লীগ সুবিধাজনক অবস্থান গ্রহণ করেছে। ‘বিরোধী দলে’ এবং ‘ক্ষমতায় থাকা’ – এই দুই অবস্থানে আওয়ামী লীগের বিশ্বাসের যে ভয়ঙ্কর পরিবর্তন ও ডিগবাজী তা বাংলাদেশকে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে চরম সংকটগ্রস্ত করে ফেলেছে। রক্তপাত ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের মাধ্যমে অর্জিত ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা জনগণের অভিপ্রায় এবং বাস্তবতা উপেক্ষা করে বাতিল করা হয়েছে। এর পরিণতিতে রাষ্ট্রকে আজ কি ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিবেচনায় নিচ্ছেন না। ফলে, জাতিকে অতি উচ্চ মূল্য দিতে হবে। বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেছেন মানুষ তিন প্রকার। ঈমান আলী, মহব্বত আলী ও মতলব আলী। ঈমান আলী সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ জীবের সঙ্গে বেঈমানী করে না। মানুষের নানান দোষ অপরাধ অপূর্ণতা সত্বেও মহব্বত আলী মানুষকে ভালোবাসে। সবচেয়ে অসুবিধা হলো যাকে নিয়ে তার নাম হলো মতলব আলী। তার মতিগতি বোঝা মুশকিল। সব ধরনের অসহযোগিতা ও অসহিষ্ণুতার গোড়ায় সে বাতাস দেয়।আমাদের সরকারও এখন মতলব আলী, মতিগতি বোঝা মুশকিল।
লেখক: গীতিকার