আমন মৌসুমেও খুলনা বিভাগে ব্যর্থ হচ্ছে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান

0

সুন্দর সাহা ॥ খুলনা বিভাগে আমন মৌসুমেও ব্যর্থ হতে চলেছে সরকারি ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান। সংগ্রহ অভিযানের অর্ধেক সময় পার হলেও কাঙ্খিত সফলতা আসেনি। তবে চাল সংগ্রহে কিছুটা সফলতা এলেও মুখ থুবড়ে পড়েছে ধান সংগ্রহ অভিযান। এবার বোরো মৌসুমে আশানুরূপ ধান চাল সংগ্রহ না হওয়ায় সরকার আমন সংগ্রহে গুরুত্ব দেয়। সারা দেশ থেকে ৩ লাখ মেট্রিক টন ধান এবং ৬ লাখ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের টার্গেট নির্ধারণ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। যার মধ্যে খুলনা বিভাগের ১০ জেলা থেকে ৪১ হাজার ৮৫৬ মেট্রিক টন ধান এবং ৮৭ হাজার ৪৪১ মেট্রিক টন চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। বাজার দরের চেয়ে সরকার নির্ধারিত সংগ্রহ মূল্য কম হওয়ায় সংগ্রহ অভিযানে ধান সংগ্রহে তেমন সাড়া মিলছে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। সংগ্রহ অভিযানের অর্ধেক সময় পার হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ৮হাজার ৪০ মেট্রিক টন ধান। যা টার্গেটের মাত্র ১৯ শতাংশ। এছাড়া ৪৮ হাজার ৫১৬ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ হয়েছে, যা টার্গেটের ৫৪ শতাংশ। যদিও সংগ্রহ অভিযান চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।


খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে সাড়ে তিন কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদিত হয়। এরমধ্যে প্রায় দেড় কোটি টন চাল আসে আমন মৌসুম থেকে। গত বোরো মৌসুমে সরকার নির্ধারিত পরিমাণে ধান চাল সংগ্রহ করতে না পারায় আমন মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ৯লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংগ্রহের টার্গেট নির্ধারণ করা হয়। এরমধ্যে ৯ লাখ মেট্রিক টন ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়। যার মধ্যে খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে যশোর জেলায় ৮ হাজার ১৫৫ মেট্রিক টন ধান কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও গত ৪৬ দিনে অর্জিত হয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ ১০৪৮ মেট্রিক টন। আর ১৫ হাজার ৯৬২ মেট্রিক টন চাল কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে ১১হাজার ২৭৮ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ৫১ শতাংশ। খুলনা জেলায় ৪ হাজার ৭৪৩ মেট্রিক টন ধান কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে মাত্র ৩২১ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ৭ শতাংশ। এছাড়া ১১ হাজার ৯৪৯ মেট্রিক টন চাল কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে মাত্র ৪১৮৭ মেট্রিক টন,যা টর্গেটের ৩৫ শতাংশ। সাতক্ষীরা জেলায় ৪ হাজার ৮৯৮ মেট্রিক টন ধান কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে মাত্র এক হাজার ৫৫৫ মেট্রিক টন,যা টর্গেটের ৩২ শতাংশ। এছাড়া ৯ হাজার ২২৭ মেট্রিক টন চাল কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে ৫ হাজার ৯৪১ মেট্রিক টন, যা টর্গেটের ৬৪ শতাংশ। বাগেরহাট জেলায় ৩ হাজার ২৪৭ মেট্রিক টন ধান কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে মাত্র ৭১ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ২ শতাংশ। ২ হাজার ৫৯৪ মেট্রিক টন চাল কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে ৫০৬ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ২০ শতাংশ। ঝিনাইদহ জেলায় ৫ হাজার ৮১৬ মেট্রিক টন ধান কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে মাত্র এক হাজার ২৭৩ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ২২ শতাংশ। এছাড়া ১১ হাজার ২৬৩ মেট্রিক টন চাল কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে ৬ হাজার ৫৪৮ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ৫৮ শতাংশ। মাগুরা জেলায় ৩ হাজার ৪৭৭ মেট্রিক টন ধান কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে এক হাজার ০২০ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ৩২ শতাংশ। এছাড়া ৩ হাজার ৭৫১ মেট্রিক টন চাল কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে ২ হাজার ২৯ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ৫৪ শতাংশ। নড়াইল জেলায় ২ হাজার ৬ মেট্রিক টন ধান কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে মাত্র ২০৪ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ৯ শতাংশ। এছাড়া ৩ হাজার ৯৫২ মেট্রিক টন চাল কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে এক হাজার ৩৭৫ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ৩৫ শতাংশ। কুষ্টিয়া জেলায় ৫ হাজার ৮৭৩ মেট্রিক টন ধান কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে মাত্র ৬৯৫ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ১২ শতাংশ। এছাড়া ২৪ হাজার ৩২৭ মেট্রিক টন চাল কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৬৭৯ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ৫২ শতাংশ। চুয়াডাঙ্গা জেলায় ২ হাজার ১০৭ মেট্রিক টন ধান কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে মাত্র ৮১৩ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ৩৯ শতাংশ। এছাড়া ৩ হাজার ৬৯৯ মেট্রিক টন চাল কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৩৫২ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ৬৪ শতাংশ। মেহেরপুর জেলায় ১ হাজার ৯৩ মেট্রিক টন ধান কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে এক হাজার ৩৬ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ৯৫ শতাংশ। ৭১৫ মেট্রিক টন চাল কেনার টার্গেট নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে ৬১৫ মেট্রিক টন, যা টার্গেটের ৮৬ শতাংশ।
সূত্র জানায়, গত বোরো মৌসুমের মত এবারের আমন মৌসুমেও হাট-বাজারে ধানের দাম বেশি। ফলে চাষিরা গুদামে আর ধান দেননি। সাম্প্রতিককালে চালের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে। চাল সরবরাহে মিল মালিকরা সরকারি প্রণোদনা পাচ্ছেন। মিল মালিকরা বাজার থেকে ধান কিনে চাল তৈরি করেছেন। এ কারণে বেড়ে যায় বোরো ধানের দাম। তাই চাষিরা খাদ্য গুদামে ধান না দিয়ে বাজারে বিক্রি করছেন। ফলে খাদ্য বিভাগের বোরো ধান সংগ্রহ অভিযান মুখ থুবড়ে পড়েছে। আবার সরকারি মূল্যের চেয়ে বাজারে চালের দাম বেশি হওয়ায় অনেক মিলার চুক্তি করেননি। মিলার ও পাইকাররা সিন্ডিকেট করে বাজারে চালের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতার কারণেই এবার বোরো ধান-চাল সংগ্রহের টার্গেট পূরণে গতি পাচ্ছে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে যশোর সদরের গুদামের ওসিএলএসডি আবুল কালামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি লোকসমাজকে জানান, ‘অন্য কোনো গুদামে কী হচ্ছে জানি না। তবে আমরা সফল। প্রথমে ২ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। যার শতভাগ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে উদ্বৃত্ত বরাদ্দ পাওয়া প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করছি। তবে, মান খারাপ হওয়ায় ধান সংগ্রহের টার্গেট পূরণ সম্ভব হবে না।’এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলার ভারপ্রাপ্ত খাদ্য নিয়ন্ত্রক প্রিয় কমল চাকমা সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি লোকসমাজকে জানান,‘ইতোমধ্যে আমরা ৬৪ শতাংশ চাল সংগ্রহ করেছি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাল সংগ্রহ অভিযান সফল হবে। তবে, ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা সফল নাও হতে পারে।’
এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ জেলার ভারপ্রাপ্ত খাদ্য নিয়ন্ত্রক হাসান মিয়া লোকসমাজকে জানান,‘ইতোমধ্যে আমরা ৫৮ শতাংশ চাল সংগ্রহ করেছি। জায়গার অভাবে ধান-চাল সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। আমরা ইন্টারন্যাল সমঝোতার মাধ্যমে চাল সংগ্রহ অভিযান সফলের চেষ্টা করছি। তবে ধান সংগ্রহের টার্গেট পূরণ করতে পারবো কিনা সেটা নিয়ে নিয়ে আমরা সন্দিহান।’ এবিষয়ে যশোর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিত্যানন্দ কুন্ডুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি লোকসমাজকে জানান, ‘যশোর জেলায় চাল সংগ্রহের পরিমাণ আশাব্যঞ্জক। তবে বাজার দরের উর্ধ্বগতির কারণে ধান সরবরাহে তেমন সাড়া মেলেনি। তাছাড়া আমন ক্ষেতের ধান কাটার আগে বৃষ্টির কারণে ধানের রং নষ্ট হয়ে যায়। এটাও ধান সংগ্রহ সফল না হওয়ার আরেকটি কারণ।’আরেক প্রশ্নের জবাবে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বলেন,‘গত বোরো মৌসুমে চুক্তি করেও ৫৭ জন মিলার গুদামে চাল সরবরাহ করেনি। তাদের জামানতের ২শতাংশ টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং এবার আমন মৌসুমে তাদের চুক্তির বাইরে রাখা হয়েছে।
এ ব্যাপারে খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহবুবুর রহমান খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি লোকসমাজকে জানান, ‘সরকার নির্ধারিত ধানের দামের চেয়ে বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্র অর্জিত হচ্ছে না। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাল সংগ্রহের শতভাগ অর্জিত হবে বলে আমরা আশাবাদী। ৮৭ হাজার ৪৪১ মেট্রিক টন চাল ক্রয়ের টার্গেটের বিপরীতে ইতোমধ্যেই ৫৪ শতাংশ অর্থাৎ ৪৮ হাজার ৫১৬ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। তবে বাজার দরের উর্ধ্বগতির কারণে ধান সংগ্রহে তেমন সফলতা আসেনি। এই মৌসুমে আমন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ৪১ হাজার ৮৫৬ মেট্রিক টন।গত বুধবার পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৪০ মেট্রিক টন ধান। যা টার্গেটের মাত্র ১৯ শতাংশ।’প্রসঙ্গত খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় গত বোরো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৫ হাজার ১৮৫ মেট্রিক টন, আর বোরো চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৪৭ হাজার ২০৫ মেট্রিক টন। বোরো ধান কৃষকদের কাছ থেকে ৫৪ হাজার ৯৭ মেট্রিক টন ধান এবং এক লাখ ২৭ হাজার ৩৪৮ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ সম্ভব হয়। এদিকে, গত বোরো মৌসুমে চুক্তি করেও যেসব মিলার গুদামে চাল দেননি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের নির্দেশনা মোতাবেক যেসব চালকল মালিক সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের পরও গুদামে চাল সরবরাহ করেননি তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। নতুন করে তাদের সাথে চুক্তি করা হয়নি। একই সাথে তাদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাসহ লাইসেন্স বাতিলের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক।