বর্জ্যের চাপে মরছে বুড়িগঙ্গা

0

সঞ্চিতা সীতু॥ যে বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল ঢাকা, সে ঢাকাই গিলে খাচ্ছে নদীটাকে। দখল-দূষণে এ নদীর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। পাড়ে নেই সবুজের ছিটেফোঁটাও। ক্রমাগত বর্জ্যের প্রকোপে পানি হয়েছে নিকষ কালো। বুড়িগঙ্গার পানি দেখলে প্রশ্ন জাগে—এটা নদী, নাকি বর্জ্যের ভাগাড়? নদী বাঁচাতে সরকারের তোড়জোড়ের শেষ নেই। তারপরও সংকট কাটছে না নদীর। কেন নদীকে বাঁচাতে চেয়েও পারছে না সরকার—এ প্রশ্ন পরিবেশপ্রেমী প্রতিটি মানুষের। বর্ষায় বান ডাকলে পত্রপত্রিকায় খবর আসে বুড়িগঙ্গায় মাছ মিলছে। অথচ নদীতে মাছ থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু দূষণে অবস্থা এখন এমন যে এ নদীতে মাছ ছেড়ে দিলে উল্টো সেটা মারা পড়বে। হাজারীবাগের চামড়া কারখানা যখন ছিল, তখন দোষ পড়তো সেটার ঘাড়ে। কিন্তু চামড়া শিল্প তুলে নেওয়ার পরও বুড়িগঙ্গার একই হাল। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বলছে, ঢাকার মধ্যে ধামরাই, কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, সাভার ও দোহারে মোট ১১০ কিলোমিটার নদী রয়েছে। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা ৮ কিলোমিটার, তুরাগ ৪২ কিলোমিটার, বালু ২৭, ইছামতি ১১, ধলেশ্বরী ১২, বংশী ১০ কিলোমিটার। এসব নদীর সমন্বয়ে ঢাকায় বৃত্তাকার নৌরুট চালু করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতে এই নৌরুট ছিল। ঢাকার একটি উপজেলা থেকে আরেক উপজেলায় নৌপথে যাতায়াত করা যেতো। এখন যা ভাবাই যায় না। নৌরুটটি সচল করতে দরকার খননের বিশাল যজ্ঞ। যার উদ্যোগ নিলেও বাস্তবায়ন হয়নি।
দূষণ আদৌ কমবে?
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘পবা’র হিসাব বলছে, ঢাকা মহানগরী ও আশেপাশের টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ এলাকার পয়ঃবর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের বর্জ্য, ট্যানারির বর্জ্য, টেক্সটাইল ডাইয়িং কারখানা, নৌযান নির্মাণ, মেরামত ও রঙ করা এবং নৌযানের বর্জ্য—সবই মিশছে নদীতে। ঢাকা ও আশেপাশের এলাকার গৃহস্থালি বর্জ্য, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্যের ৪০ শতাংশ (দিনে প্রায় ৩ হাজার টন) নালা-নর্দমা, খাল, জলাভূমি হয়ে নদীতে পড়ছে। ঢাকার পয়ঃবর্জ্যের পরিমাণই দিনে প্রায় ১৪ লাখ ঘনমিটার। পাগলা পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনাগারে মাত্র ৫০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন হচ্ছে। বাকি সাড়ে ১৩ লাখ বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। ট্যানারিগুলো থেকে দিনে ২২ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য পড়ছে নদীতে। এ ছাড়া মৌসুম ভেদে কঠিন বর্জ্যের পরিমাণ থাকে ১০০ থেকে ২০০ মেট্রিক টন। বিভিন্ন শিল্পকারখানার ১ লক্ষ ২০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্যও পড়ছে নদীতে। নৌযান থেকে সৃষ্ট বর্জ্য ধারণে ব্যবস্থা না থাকায় সেটাও পড়ছে নদীতে। এসব বন্ধ না হলে নদীর পানির অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটবে না বলেই জানালেন বিশেষজ্ঞরা। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে দূষণের কেন্দ্র ছিল নারায়ণগঞ্জ। এরপর হাজারীবাগের ট্যানারি। এখন ট্যানারি সাভারে গেছে। দূষণের কেন্দ্রও বদলেছে। তবে মাথায় রাখতে হবে দূষণের মূল কারণ কারখানা। কারখানা বন্ধ করতে বলছি না। পরিশোধন প্ল্যান্ট করার বিষয়টিতে জোর দিচ্ছি। আমাদের গবেষণায় বুড়িগঙ্গার পানিতে ক্যাডমিয়াম, সালফাইড ও অ্যামোনিয়ার উপস্থিতি অনেক বেশি পেয়েছি।’ তিনি আরও জানান, ‘আগে বর্ষায় দূষণের মাত্রা কম হতো। এ বছর এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত জরিপে দেখা গেছে মাত্রা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে মাত্রা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছি।’
দখলের থাবা
নদী রক্ষা কমিশনের পরিদর্শন বলছে, ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর মধ্যে তারা যে পরিদর্শন করেছে, তাতে ২৩৫টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত হয়েছে। এর বাইরেও অনেক অবৈধ স্থাপনা রয়েছে যেটার তালিকা তাদের কাছে নেই। অবৈধ স্থাপনার মধ্যে ইছামতিতে ৭৫, ধলেশ্বরীতে ১০০ আর বংশীতে ৬০টি স্থাপনার তালিকা তাদের কাছে রয়েছে। তালিকার পরও কেন উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না সে প্রশ্ন এখনও রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দখলবাজের তালিকায় এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা বেশ প্রভাবশালী। কিন্তু রাষ্ট্রের চেয়ে বড় প্রভাব নিশ্চয়ই তাদের নেই। তবু কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না সেটা চিন্তার বিষয়। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, কমিশনের শুরুতেই দখলদারদের তালিকা করেছিলাম। কিছু উচ্ছেদও হয়েছিল। মূল সমস্যা হচ্ছে বড় ব্যবসায়ী এবং তাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ। এ কাজে পানিসম্পদ এবং নৌ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে নদী রক্ষা আইন সংশোধন করে সংসদে পাঠানো হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীও চান নদীগুলো রক্ষা পাক। কিন্তু সুবিধাভোগী কিছু মানুষের কারণে দখলমুক্ত হচ্ছে না। আইন না হলে, মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা না পেলে এ কাজ একা কমিশনের পক্ষে করা সম্ভব নয় বলে তিনি জানান।
যা করার আছে
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহম্মদ এজাজ বলেন, দূষণের সমাধান দু’ভাবে হতে পারে। এখনই একটি উদ্যোগ নেওয়া যায়। অন্যটি দীর্ঘমেয়াদি। এখন যা করা যায়—সাধারণত তিন ধরনের লাইনের মাধ্যমে পয়ঃবর্জ্য বুড়িগঙ্গায় পড়ে; খাল দিয়ে সরাসরি আসছে, মাঝারি পাইপ ও বড় পাইপ দিয়ে পড়ছে; প্রাথমিকভাবে এই পাইপগুলোর মুখে ফিল্টার বসানো যায়। তিন স্তরের জালি বসালেও দূষণ কিছুটা কমবে। দীর্ঘমেয়াদে দরকার হবে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা বর্জ্য শোধনাগার। এ ব্যবস্থায় পুকুর বা যেকোনও বায়োলজিক্যাল চেম্বারে বর্জ্যটা ফেলে পানি শোধন করে নদীতে ফেলতে হবে। এর বাইরে আপাতত আর কোনও সমাধান নেই। প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, কারখানাগুলোতে সরকার ইটিপি প্ল্যান্ট স্থাপন বাধ্যতামূলক করলেও সবাই সেটি করছে না। অনেকে স্থাপনা করেছে, কিন্তু প্ল্যান্ট চালু করেনি। এই বিষয়ে সরকারের আরও কঠোর হওয়ার কোনও বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, ইটিপির পূর্ণরূপ- এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তথা তরল বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ স্থাপনা। কারখানার তরল বর্জ্য থেকে পরিষ্কার পানি আলাদা করতে এ ধরনের প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়। দূষিত পানি উৎপাদনকারী সকল কারখানাতেই ইটিপি ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
ইতিহাসে ঢাকার নদী
ইতিহাস বলছে, ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যার পানি এক স্রোতে মিশে বুড়িগঙ্গার সৃষ্টি হয়েছিল। মূলত ধলেশ্বরী থেকে বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি। বর্তমানে উৎসমুখটি ভরাট হওয়ায় পুরনো প্রবাহের কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। মোহম্মদ এজাজ বলেন, বালু নদী ছিল গুলশান পর্যন্ত, তুরাগ ছিল শ্যামলী পর্যন্ত। দখলের কারণে এগুলো কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা সবাই জানে। এদিকে বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে পুরান ঢাকা। ধলেশ্বরী থেকেই এসেছে বুড়িগঙ্গা। শীতলক্ষ্যাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জ। তিনি বলেন, বর্জ্যের কারণে প্রতিদিন বুড়িগঙ্গার তিন লাখ কিউবিক মিটার পানি দূষিত হচ্ছে। নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। ওয়েট ল্যান্ড দখলের ফলেও নদী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ঢাকার তাপমাত্রাও বাড়ছে। ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।