অতিরিক্ত বেতন ফি’র চাপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে

0

পিয়াস সরকার॥ ১৬০০ টাকা মাসিক বেতন আদিবার। করোনায় বিপর্যস্ত বাবার ব্যবসা। আগে নিয়মিত মেয়ের স্কুলের বেতন দিলেও এখন তা দিতে পারছেন না। বেতন না দিতে পারায় স্কুলের খাতা থেকে নাম বাদ পড়েছে আদিবার। এখন অপেক্ষা করছেন নতুন বছরে নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার। আদিবা রাজধানীর ওয়াইডব্লিউসিএ উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। স্কুলে পরীক্ষা চলছে কিন্তু তাতে অংশ নিতে পারছে না আদিবা। আদিবার বাবা বলেন, অনেকবার স্কুলে আবেদন করেছি। কোনো লাভ হয়নি।
তারা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন অর্থ পরিশোধ না করলে বসতে দেয়া হবে না পরীক্ষায়। আমার লেদারের ব্যবসা। করোনাকালে ব্যবসায় নেমেছে ধস। আগে বেতন ঠিকমতো দেয়া হলেও এখন তারা মেনে নিচ্ছেন না কিছুই। তিনি আরও বলেন, মেয়ের মুখের দিকে তাকানো যায় না। নিজের কাছেই অসহায় লাগে। আদিবার মতো রাজধানীতে অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী অভিভাবক এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। করোনাকালে বকেয়া বেতন আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষার্থীরা করোনাকালে অনলাইনে ক্লাস করলেও নেয়া হচ্ছে পূর্ণ বেতন। এমনকি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে বেতন ছাড়া কোনো ফি আদায় করতে না করা হলেও প্রতিষ্ঠাগুলো মানছে না তা। বছরের পুরো বেতন ও অন্যান্য ফি আদায় করেই বসতে হচ্ছে পরীক্ষায়। রাজধানীর স্বানামধন্য ভিকারুননিসা উচ্চ বিদ্যালয়েও ফি আদায়ের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে সংবাদ সম্মেলন করে। অভিভাবক আনিসুর রহমান আনিস বলেন, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে মানা হচ্ছে না এই নিয়ম। তারা পূর্ণ বেতন আদায় করছেন। শুধু তাই নয়, ২০২১ সালের জন্য তিন হাজার টাকা করে নেয়া হচ্ছে সেশন ফি। তিনি আরও বলেন, করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত অভিভাবকদের সন্তানদের টিউশন ফি মওকুফ না করা, টিউশন ফি না দিলে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ না করার জন্য ছাত্রীদের মানসিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ২৮০০ টাকার জমানোর লড়াইয়ে নেমেছেন আমিনুল ইসলাম। তার মেয়ে রাজধানীর শারুলিয়া, ডেমরা এলাকায় হাজী মোয়াজ্জেম আলী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। প্রতিষ্ঠান থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে আট মাসের ৩৫০ টাকা করে বকেয়া বেতন পরিশোধ না করলে বসতে দেয়া হবে না পরীক্ষায়। আমিনুল ইসলাম বলেন, আমি একটা হার্ডওয়্যার দোকানে কাজ করতাম। করোনার সময় চাকরি চলে যায়। এখন ফের কাজে ঢুকলেও আয় কমে গেছে অর্ধেক। এখন এই ২৮০০ টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছি। টাকার জন্য মেয়েটা পরীক্ষা দিতে পারবে না- তাতো হতে পারে না। মণিপুরি স্কুল এন্ড কলেজের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আনাস করোনায় হারিয়েছে বাবাকে। বাবাকে হারানোর শোক থেকে স্কুল নিয়েও বিপাকে তার মা। ফেব্রুয়ারি থেকে যে দেয়া হয়নি কোনো বেতন। প্রতিমাসের বেতন ১২৫০ টাকা করে। তার মা ঝর্ণা রহমান বলেন, একাধিকবার স্কুলে আবেদন করেও মেলেনি কোনো সুফল। এদিকে সন্তানের স্কুলে ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন একটি ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ আতিক হাসান। তিনি কাজ করেন চুক্তিভিত্তিক। আতিক বলেন, করোনার সময় ওষুধের চাহিদা বাড়লেও আমাদের আয় নিম্নমুখী হয়ে যায়। অবস্থা এতোটাই শোচনীয় যে, পরিবারকে ঢাকা থেকে বাড়িতে (বগুড়া) পাঠিয়ে দিতে হয়েছে। আমার মেয়ে তকি আদাবরের সান গ্লোরি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। অর্থ না দিতে পারায় ওকে গতবছরের মাঝামাঝি থেকে আর অনলাইন ক্লাসে পাঠায়নি। এখন ওই স্কুলেই চতুর্থ শ্রেণির জন্য ভর্তি করাতে চাইলে তারা বলছে সম্পূর্ণ বকেয়া বেতন পরিশোধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এখন কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় আমার আয়। চিন্তা করছি পরিবারকে আবার ঢাকায় নিয়ে আসবো। মেয়ে চাচ্ছিল আগের স্কুলেই পড়তে। কিন্তু তাদের চাহিদামতো বকেয়া ৫ হাজার ৪০০ টাকা দেয়া কষ্টকর। আবার নতুন স্কুলে ভর্তির জন্য খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারেন সেখানে ভর্তির জন্য ৮-১০ হাজার টাকা লাগবে। করোনার ছুটি পরবর্তী সময়ে স্কুলের বেতন নিয়ে প্রশাসন কড়া। কিন্তু শিক্ষকদের বকেয়া বেতন দিতে নারাজ তারা। সাইফুল ইসলাম মনসুরাবাদের ক্রিয়েটিভ স্কুলের শিক্ষক। তিনি বলেন, আমরা করোনার সময় দুই মাস বেতন পাইনি। আর সাত মাস বেতন পেয়েছি অর্ধেক। আর দু’মাস ৭৫ শতাংশ। আমরা আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইনে চালিয়ে গেছি। এখন শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার আগে বকেয়া বেতন সব তুলে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের করোনাকালে পাওনা টাকার বিষয়ে কোনো কথা বলছেন না তারা। প্রধান শিক্ষককে জানালে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের কাছে পুরো অর্থ উঠলে ভেবে দেখা হবে। আসছে নতুন বছর। আর ক’দিন বাদে শুরু হবে ভর্তি কার্যক্রম। কিন্তু স্কুলে ভর্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলো রীতিমতো স্বেচ্ছাচারিতায় মেতে উঠেছে। রাজধানীর ব্যবসায়ী খুরশিদ আলম আজাদ। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি সবই মগবাজারে। তার দুই সন্তান পড়ে রাজধানীর বিয়াম স্কুলে। দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য বাড়ির পাশে স্কুলে ভর্তি করাতে চান হাউজ পয়েন্ট স্কুল এন্ড কলেজে। কিন্তু প্রথম শ্রেণি ও নবম শ্রেণিতে দুই সন্তানকে ভর্তি করাতে প্রতিষ্ঠান থেকে চাওয়া হয়েছে ২৫ হাজার করে ৫০ হাজার টাকা। আজাদ বলেন, তারা ভর্তি ফি ধরেছেন ১০ হাজার টাকা আর উন্নয়ন ফি ধরেছেন ১৫ হাজার টাকা।