রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উপদল: শঙ্কা, উদ্বেগ

0

রাসেল চৌধুরী॥ রোহিঙ্গা মুহিবুল্লাহ খুনের ঘটনায় ক্যাম্পগুলোতে আতঙ্ক কাটেনি। এখনো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। চারদিকে অস্থিরতা, চাপা উত্তেজনা ও ক্ষোভ। মুহিবুল্লাহ খুনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ তার সমর্থকরা। এ ঘটনার পর প্রতিশোধমূলক ঘটনার অবতারণা হতে পারে এমন আশঙ্কায় সতর্ক রয়েছে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থানকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন গ্রুপ বা উপদল সক্রিয়। সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরসা, আল ইয়াকিনসহ একাধিক সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। প্রতিশোধ পরায়ণ এই গ্রুপগুলো একের পর এক রক্তপাতসহ নানা অপকর্ম করছে।
সর্বশেষ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনায় ক্যাম্পজুড়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর অনুসারীরা এই হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা সাধারণ রোহিঙ্গাদের। তাদের দাবি মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস সংগঠনটি বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এই সংগঠন রোহিঙ্গাদের সব সময় শান্তির পথ দেখাতো। এ কারণে সাধারণ শান্তিপ্রিয় রোহিঙ্গাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। আর এ কারণেই প্রত্যাবাসন বিরোধী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর টার্গেটে পরিণত হন মুহিবুল্লাহ। প্রত্যাবাসন বিরোধী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতেই রোহিঙ্গাদের এই শীর্ষ নেতা খুন হন বলে ধারণা সাধারণ রোহিঙ্গাদের। মাস্টার মুহিবুল্লাহ আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান ছিলেন। রোহিঙ্গাদের যত সংগঠন ও নেতা রয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম এই মুহিবুল্লাহ। রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে মূলত তিনি ওই সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। এই সংগঠনের নেতা হিসেবে তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০১৯ সালের ২২শে আগস্ট রোহিঙ্গা শিবিরে মহাসমাবেশ করে আলোচনায় আসেন মুহিবুল্লাহ। একই বছরের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ১৭ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যে ২৭ জন প্রতিনিধি অভিযোগ দেন মুহিবুল্লাহ ছিলেন তাদের একজন। ওই সময় রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মুহিবুল্লাহ জোরালো বক্তব্য রাখেন। দেশ-বিদেশে তার সুনাম ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নেতৃত্ব দেয়ায় সহ্য করতে না পেরে তাকে নিশানা করে থাকতে পারে তার প্রতিপক্ষ গ্রুপ।
সাধারণ রোহিঙ্গারা জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভয়ানক পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। শুরু থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হলে আজ এমন আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি হতো না। তাদের দাবি, দিনের বেলায় ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হলেও রাতের চিত্র পাল্টে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক রোহিঙ্গা জানান, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্বীকৃত ক্যাম্পের নেতাদের সঙ্গে অস্বীকৃত ক্যাম্পের নেতাদের মধ্যে অন্তঃকোন্দল দীর্ঘদিনের। এক রোহিঙ্গা গ্রুপ অন্য রোহিঙ্গা গ্রুপকে সহ্য করতে না পারা এবং নেতৃত্বের আধিপত্যকে ঘিরে ক্যাম্পের পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠেছে।
একজন রোহিঙ্গা নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত বছরের ২রা সেপ্টেম্বরের কথা আমরা ভুলিনি। অপহরণ, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের ই-ব্লকের মোহাম্মদ ফরিদ ও এফ-ব্লকের নুর হাশিম, মাস্টার মুন্না এবং আনরেজিস্টার্ড ক্যাম্পের নেতা রফিক উদ্দিন, হাফেজ জাবেদ ও সাইফুলের মধ্যে অন্তঃকোন্দল শুরু হয়। সেই থেকে ক্যাম্পে অপহরণ বাড়ার পাশাপাশি রাতে মুখোশধারী সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বেড়েছে। এতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানান তিনি। বছর যেতে না যেতেই আবারো গুলি করে হত্যা করেছে আমাদের রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহকে।
স্থানীয়রা বলছেন, অপহরণকারী ও মুখোশধারী রোহিঙ্গা অপরাধীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এছাড়া প্রত্যাবাসনের পক্ষে-বিপক্ষে রোহিঙ্গারা দ্বিধা-বিভক্তিতে রয়েছে। তাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারে সংঘর্ষ-গোলাগুলি লেগেই থাকে। হত্যাকাণ্ড-চাঁদাবাজি ঘটছে প্রতিনিয়ত।
১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক এসপি নাঈমুল হক জানান, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত তিন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ক্যাম্পে যেকোনো বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ নিহত হওয়ার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে এআরএসপিএইচ কার্যালয়ে একদল অস্ত্রধারীর গুলিতে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ নিহত হন।