মুহিবুল্লাহ হয়ে ওঠার নেপথ্যে-

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি আলোচিত নাম মুহিবুল্লাহ। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মংডু এলাকায় তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। শিক্ষাগ্রহণ করেছেন মিয়ানমারেই। ছিলেন শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন সোচ্চার। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ার প্রতিবাদে আরাকানে যেসব রোহিঙ্গা নেতা সোচ্চার ভূমিকা রাখেন মুহিবুল্লাহ তাদের অন্যতম। মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারের মংডু এলাকার লংডাছড়া গ্রামের মৌলভী ফজল আহমদের ছেলে। রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র বাহিনীর রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)-এ প্রধান ভূমিকায় কাজ করার অভিযোগ ওঠার পর ১৯৯২ সালে মুহিবুল্লাহ মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। এরপর থেকেই তিনি কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে বসবাস শুরু করেন। উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প ও ক্যাম্পটির আশপাশে বেশি সময় ধরে বসবাসের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তিনি ছিলেন সোচ্চার কণ্ঠ। সর্বশেষ কুতুপালং ক্যাম্প-১ লম্বাশিয়া ইস্ট-ওয়েস্ট ব্লকের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। ২০০০ সালের শুরুতে ১৫ জন সদস্য নিয়ে মুহিবুল্লাহ গড়ে তোলেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’- নামের সংগঠন। এই সংগঠন রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ শুরু করে। অধিকার কর্মী হিসেবে কক্সবাজারের স্থানীয়দের সঙ্গেও মুহিবুল্লাহ গড়ে তোলেন সুসম্পর্ক। সংগঠন গড়ে তোলার পর কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান তিনি। তাদের জমায়েত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাদের নেতা হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে নিয়মিত যাতায়াত করায় তিনি দুই পাশের রোহিঙ্গাদের মধ্যে সমানভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট মিয়ানমার সেনাদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে মংডু টাউনশিপের সিকদারপাড়া গ্রাম থেকে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন তিনি। এরপর আবারও আশ্রয় নেন উখিয়া ক্যাম্পে। সবকিছু আগে থেকে জানা-শোনা থাকায় ওখানকার মানুষের সঙ্গে মিশতে তার বেশি সময় লাগেনি। আবারও তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাংগঠনিক কাজ শুরু করেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেশ কিছু সংগঠন কাজ করলেও মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে পরিচালিত এআরএসপিএইচ সংগঠনটি বেশ শক্তিশালী। মুহিবুল্লাহর সংগঠনে ৩০০ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছেন বলে জেলা প্রশাসক স্বাক্ষরিত একটি তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ দেশের বাইরে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন একাধিকবার। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ১৭ দেশের যে সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ২৭ প্রতিনিধি সাক্ষাৎ করেন তাদের একজন ছিলেন মুহিবুল্লাহ। যুক্তরাষ্ট্রের এ সফর দেশজুড়ে আলোচনায় এলে মুহিবুল্লাহ বেশ পরিচিতি লাভ করেন এবং রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যায়িত হন। ২০১৯ সালের ২৫শে আগস্ট রোহিঙ্গা আগমনের বর্ষপূর্তিতে। তিনি লাখো রোহিঙ্গার সমাবেশ ঘটিয়ে আলোচনায় আসেন। সেদিন তার নেতৃত্বে ৩ থেকে ৫ লাখ রোহিঙ্গার মহাসমাবেশ হয়। এরপর তিনি উখিয়া-টেকনাফের ৩২ রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে আরো প্রভাব বিস্তারকারী নেতা হয়ে ওঠেন। রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে দক্ষ মুহিবুল্লাহ ধীরে ধীরে প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন রোহিঙ্গাদের। ২৫শে আগস্ট মাত্র কয়েক ঘণ্টার প্রস্তুতিতে কীভাবে এতো বড় মহাসমাবেশের আয়োজন করেছিলেন মুহিবুল্লাহ ও তার সংগঠন। এর উত্তরে মুহিবুল্লাহ জানিয়েছিলেন, উখিয়া- টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে তার সংগঠনের দুই হাজার নেতাকর্মীকে মোবাইল ফোনে নির্দেশনা পৌঁছে দেয়া হয়। এরপর কর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে মহাসমাবেশে উপস্থিত হওয়ার কথা জানায়। জাতিসংঘ মহাসচিবসহ যতো বিদেশি প্রতিনিধি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেছেন তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই রোহিঙ্গা প্রতিনিধি হিসেবে মুহিবুল্লাহ ও তার সঙ্গীদের সাক্ষাৎ হয়েছে। মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিবকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও সমপ্রতি বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নাগরিকত্ব দেয়ার অনুরোধ জানালে বাংলাদেশের পাশাপাশি এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে রোহিঙ্গারা নিজ ভূমে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন রোহিঙ্গাদের সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ (এআরএসপিএইচ)। বুধবার রাতে কুতুপালং ক্যাম্পে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তের গুলিতে মারা যান ৪৬ বছর বয়সী মুহিবুল্লাহ। তার মৃত্যুতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন তার জানাজা ও দাফন হয় কুতুপালংয়ে। নিরাপত্তা কড়াকড়ি থাকলেও মুহিবুল্লাহর জানাজায় হাজারো মানুষ অংশ নেন। স্থানীয়দের দাবি তাকে শেষবার একনজর দেখতে আসা জনস্র্রোত প্রমাণ করে তিনি কতোটা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কাছের নেতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।