‘শেল ব্যাকিং’র মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা খতিয়ে দেখা হবে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ দেশ থেকে অর্থপাচার বন্ধ করতে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ‘শেল ব্যাংকিং’ এর সঙ্গে কোন কোন ব্যাংক জড়িত তা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ‘শেল ব্যাকিং-এর সঙ্গে যে সব ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সম্প্রতি ‘মানি-লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত ওয়ার্কিং কমিটি’র এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
‘শেল ব্যাংক’ হচ্ছে এক ধরনের বিশেষ ব্যাংকিং ব্যবস্থা যাতে ব্যাংক গ্রাহকের নাম-ঠিকানা ছাড়া শুধু একটি কোড নম্বরের ভিত্তিতে হিসাব খুলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালনা করা যায়। নাম-ঠিকানা থাকে না বলে এতে গ্রাহকের পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। যে কারণে এর মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে মানি লন্ডারিংয়ের বিশেষ সুযোগ রয়েছে। বিশ্বজুড়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে শেল ব্যাংকিং নিষিদ্ধ। বাংলাদেশেও শেল ব্যাংকিং নিষিদ্ধ।
সূত্র জানায়, ওয়ার্কিং কমিটির সভায়, দেশ থেকে অর্থপাচার রোধে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধ করার জন্য তৎপর হওয়ার আহবান জানানো হয়। বলা হয়েছে, এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করবে। পাশাপাশি ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং প্রতিরোধে কোনো তফসিলি ব্যাংক ‘শেল ব্যাংক’-এর সঙ্গে লেনদেন করতে পারবে না। ইতোমধ্যে যেসব তফসিলি ব্যাংক ‘শেল ব্যাংক’-এর সঙ্গে লেনদেন করেছে এবং ব্যাংকগুলো কী পরিমাণ অর্থ এ প্রক্রিয়ায় লেনদেন করেছে তা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সভায় জানানো হয়, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার বিষয়ে গত ডিসেম্বরে অ্যাটর্নি জেনারেল-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ দেশে ফেরত আনার বিষয়ে গঠিত আন্ত:সংস্থা টাস্কফোর্স’-এর সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শেল ব্যাংকিংগুলো চিহ্নিত এবং সে অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে সন্ত্রাসে অর্থায়ন ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সভায় উল্লেখ করা হয়, শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে দাম বেশি দেখিয়ে অর্থপাচার বেশি হচ্ছে। ব্যাংকগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব যন্ত্রপাতির সঠিক দাম সম্পর্কে অবগত নয়। এর বাইরে অন্যান্য আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে ও রপ্তানির দাম কম দেখিয়ে বা দেশে না এনে অর্থপাচার করা হচ্ছে।
এরআগে এ-সংক্রান্ত এক বৈঠকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এলসি’র ক্ষেত্রে তদারকি আরও বাড়ানোর পাশাপাশি ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং ঠেকাতে ব্যাংকের নিজস্ব ডাটাবেজ তৈরি, কেন্দ্রীয় একটি ডাটাবেজ গড়ে তোলা এবং ভ্যাসেল ট্র্যাকিং ও কনটেইনার ট্র্যাকিং করার পরামর্শ দিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।
এখানে উল্লেখ্য, বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ (জিএফআই)-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচার হয়। ট্রেড মিস-ইনভয়েসিং (আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং)-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ২০১৩ সালে ৯৬০ কোটি ডলার, ২০১৪ সালে ৬৩০ কোটি ডলার ও ২০১৫ সালে ৫৯০ কোটি ডলার অবৈধভাবে দেশের বাইরে চলে গেছে।
জিএফআই-এর ‘ট্রেড-রিলেটেড ইলিসিট ফাইন্যান্সিয়াল ফ্লোজ অ্যান্ড ১৩৫ ডেভেলপিং কান্ট্রিজ : ২০০৮-২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অবৈধভাবে অর্থ পাচারকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩ তম। বাংলাদেশ থেকে প্রধানত ১০টি দেশে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। এসব দেশের তালিকায় রয়েছে-কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেইম্যান আইল্যান্ডস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস।
সূত্র জানায়, ওয়ার্কিং কমিটি’র সভায় দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত গৃহীত কার্যক্রমগুলোর অগ্রগতি নিয়েও আলোচনা হয়। এ বিষয়ে সভায় বলা হয় যে, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে বিভিন্ন দেশ সাফল্য অর্জন করলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের নজির খুবই সামান্য।
আশা করা হচ্ছে, নতুন ব্যবস্থায় কোন কোন ব্যাংক শেল ব্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার করছে তা চিহ্নিত করা গেলে অর্থ পাচার অনেকটাই রোধ করা সম্ভব হবে।